১৯৭৫ সালের নভেম্বর। সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের আতঙ্ক, ভয় ও অস্থিরতায় ঢাকা শহর নগরী।
৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। রাত আনুমানিক ১.৩০-২টা। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে একটি পিকআপ থামে। তাতে ছিলেন কয়েকজন সশস্ত্র সেনা সদস্য। রাত দেড়টার দিকে কারা মহাপরিদর্শক তৎকালীন জেলার আমিনুর রহমানকে ফোন করে তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে যেতে বলেন। আমিনুর রহমান দ্রুত কারা ফটকে গিয়ে দেখেন, কয়েকজন সশস্ত্র সেনা সদস্য সেখানে অপেক্ষা করছেন। তারা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দেন, যা জেলা ঠিকমতো পড়তে পারেননি।
সেসময় কারাফটকের পাশে জেলারের কক্ষে ফোন বেজে ওঠে। জেলা অফিসারকে বলা হয় প্রেসিডেন্ট আইজির (প্রিজন) সঙ্গে কথা বলতে চান। আইজি এসে ফোনে কথা বলার পর বলেন, “আর্মি অফিসাররা যেভাবে চান, তোমরা সেভাবে করো।” এই আলাপচারিতা মূল ফটকে রাত ৩টা পর্যন্ত চলে।
এরপর নির্দেশনা আসে জাতীয় চার নেতা—তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান—একত্রিত করার। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদ একটি কক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে অপর কক্ষে থেকে সেখানে আনা হয়। চারজনকে একই কক্ষে এনে হত্যা করা হয়। বেয়নেটের আঘাতে তাদের শরীর ছিন্নভিন্ন করা হয়। পরিবারও ঘটনার খোঁজ পায়নি।
৪ নভেম্বর, পুরান ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দিন আহমেদের পরিবারকে জানান, তিনি আগের রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতর গুলির আওয়াজ শুনেছেন। পরদিন খবর আসে জাতীয় চার নেতার মৃত্যুর।
জাতীয় চার নেতার ইতিহাস ও রাজনৈতিক গুরুত্ব
এই চার নেতা ছিলেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তারা প্রবাসী সরকার পরিচালনা করেন এবং দেশের মানুষকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি মজবুত করেন। বঙ্গবন্ধুর পর এই চারজন ছিলেন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের পর, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের ভেতরে নেতৃত্ব নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়। একদিকে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, অন্যদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ। তারা আশংকা করছিলেন, যদি পাল্টা আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান হয়, তাতে আওয়ামী লীগের নেতারা সমর্থন দেবেন। সেই কারণে, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড মূলত একই ষড়যন্ত্রের অংশ। হত্যাকারীরা মূলত পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তরুণ প্রজন্মের মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ মুছে ফেলা এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা।
বিচার প্রক্রিয়া ও মামলার অগ্রগতি
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১১ জন আসামিকে বিচারিক আদালত দণ্ড দেওয়ার পর কেটে গেছে ২০ বছরেরও বেশি সময়। তবে রায় কার্যকর হয়েছে একজন খুনির—ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ।
জেল হত্যা মামলায় আজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত মাজেদ দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর ৭ এপ্রিল, ২০২০-এ গ্রেফতার হন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলারও দণ্ডিত ছিলেন এবং সেই মামলার রায় অনুযায়ী তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
একমাত্র মাজেদের ফাঁসি কার্যকর হওয়া ছাড়া জেল হত্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবায়নে তেমন অগ্রগতি নেই। বিদেশে আত্মগোপনে থাকা অন্যান্য দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে দুজন—রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী—কে সরকার চিহ্নিত করেছে। রাশেদ যুক্তরাষ্ট্রে, নূর কানাডায় অবস্থান করছেন। আইনী জটিলতার কারণে তাদের দেশে আনা সম্ভব হয়নি।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরই জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে বন্দী করা হয়। চার নেতার হত্যার পর পরদিন লালবাগ থানায় একটি এফআইআর দায়ের করেছিলেন তৎকালীন উপ-কারা মহাপরিদর্শক কাজী আব্দুল আওয়াল। তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় লালবাগ থানার ওসি এ বি এম ফজলুল করিমকে। তিনি সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্তের মাধ্যমে ঘটনার স্থান থেকে আলামত সংগ্রহ করেন।
১৯৭৫ সালে জারি হওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের বৈধতা দেন সামরিক শাসক জিয়া। এর ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ জেল হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ২১ বছর পর, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) পুনরায় তদন্তের দায়িত্ব নেয়।
মামলার রায় ও আসামিদের অবস্থা
মামলা দায়েরের ২৯ বছর পর, মহানগর দায়রা আদালত মামলার রায় ঘোষণা করে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩ জন: রিসালদার মোসলেহউদ্দিন, দফাদার মারফাত আলী শাহ, দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধা।
আজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জন:
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান
মেজর (অব.) মোহাম্মদ বজলুল হুদা
মেজর (অব.) এ.কে.এম. মহিউদ্দিন আহমেদ
কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শরিফুল হক দালিম
কর্নেল (অব.) এম.বি. নূর চৌধুরী
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এ.এম. রাশেদ চৌধুরী
মেজর (অব.) আহমেদ শরিফুল হোসেন
ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মজিদ
ক্যাপ্টেন (অব.) কিসমত হাশেম
ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার
পরবর্তীতে, আজীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত চারজন—সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মোহাম্মদ বজলুল হুদা, এ.কে.এম. মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার)—উচ্চ আদালতে আপিল করেন এবং খালাস পান। অন্য আট আসামির আজীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে।
আসামি দফাদার মারফাত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাসেম মৃধাকে উচ্চ আদালতের রায়ে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায় সুপ্রিম কোর্ট পুনর্বহাল করে। সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মোহাম্মদ বজলুল হুদা ও এ.কে.এম. মহিউদ্দিন আহমেদ জেল হত্যা মামলায় অব্যাহতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন।



