রাখাইনে মানবিক করিডোর: অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ, বিতর্ক

জাতিগত সংঘাতে বাস্তুচ্যুত এরকম লাখ লাখ মানুষের মিছিল দেখা গেছে বাংলাদেশমুখী।
জাতিগত সংঘাতে বাস্তুচ্যুত এরকম লাখ লাখ মানুষের মিছিল দেখা গেছে বাংলাদেশমুখী।

গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পাঠাতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডোরে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সিদ্ধান্তটি ঘিরে বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভাষ্যে মিলছে উত্তাপের আঁচ, আর বিশ্লেষকদের বয়ানে উদ্বেগ-বিতর্ক।

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বৈধতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন রোববার শর্ত সাপেক্ষে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডোর চালুর বিষয়ে সরকারের নীতিগত সম্মতির কথা প্রকাশ্যে আনেন।

এ অবস্থায় এই করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান কীভাবে প্রভাবিত হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

জার্মানির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের খবরে তিনটি শর্তে করিডোর চালুর ব্যাপারে সম্মতি দেওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। প্রথমত, করিডর চালুর এলাকায় যুদ্ধাবস্থা থাকবে না, দ্বিতীয়ত, নিরপেক্ষভাবে মানবিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, এবং শর্তহীন ত্রাণ বিতরণ।

এই শর্তগুলো মেনে চলার নিশ্চয়তা না পেলে করিডর চালু হবে না বলে বাংলাদেশের পক্ষে জানানো হয়েছে বলেও ডয়েচে ভেলের খবরে তুলে ধরা হয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান কালবেলাকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “মানবিক করিডোর নিয়ে কথা বলা পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এতে সন্দেহ হয়! সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা আছেন। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টার কথা বলা উচিত।”

করিডোর দেওয়া নিয়ে সতর্কতা অবলম্বনের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি আরও বলেন, “করিডোর কেমন হবে, কী যাবে, শর্ত কী হবে, তা অবশ্যই জানাতে হবে। এগুলো না জানালে সন্দেহ তৈরি হবে।”

এদিকে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনে আওয়ামী লীগশূন্য রাজনীতির মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো বিএনপি প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্রের এরকম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের রয়েছে কি না।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ থেকে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের যে ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে তাতে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মির্জা ফখরুল বলেছেন, “আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না। আর যুদ্ধ দেখতে চাই না।”

তিনি বলেন, “আরাকানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন হিউম্যানিটিরিয়ান প্যাসেজ নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ ছিল।”

অন্যদিকে, গবেষক আলতাফ পারভেজও জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও দেশের সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ বা প্রশাসনের কেউ জানেন না।”

করিডোরের সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে অন্তর্ভুক্ত না থাকলে বাংলাদেশের জন্য তা লাভজনক হবে না বলেও তার অভিমত।

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, “করিডোরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতে থাকতে হবে। অন্যথায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে।”

ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা

মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকাটি শুধু এই দুই দেশের মধ্যকার সমস্যা নয়; এখানে যুক্ত রয়েছে ভারত, চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থও। পশ্চিমা দেশগুলো বহুদিন ধরেই বাংলাদেশকে মানবিক করিডোর খোলার পরামর্শ দিয়ে আসছিল। অবশ্য রাজনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় কোনো সরকারই সেপথ মাড়ায়নি।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনে বর্তমানে ৮০ শতাংশ এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনী সেখানে খাদ্য ও ওষুধের প্রবেশ বন্ধ করে রেখেছে, যার ফলে সেখানে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ অবস্থা তৈরি হয়েছে।

ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রাখাইন রাজ্যে বিবদমান পক্ষের কারণে বেশিরভাগই মানবিক সহায়তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন। জাতিসংঘ আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করে বলেছে, সেখানে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ অনাহারে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

জাতিসংঘ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, মানবিক সংকট বাড়তে থাকলে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে নতুন করে শরণার্থী প্রবাহ শুরু হতে পারে।

জাতিসংঘের এরকম উদ্বেগের মধ্যেই গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় এক লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে সরকারি তথ্যে উঠে এসেছে।

সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি

ডয়েচে ভেলের সঙ্গে আলাপে সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) এম শহীদুল হক সরাসরি সতর্ক করে বলেছেন, “আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের সম্মতি ছাড়া করিডোর চালু হলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াবে।”

অতীতে বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতময় অঞ্চলে (যেমন বসনিয়া, কুর্দিস্তান ও ইউক্রেন) মানবিক করিডোর খোলার পর সামরিক হস্তক্ষেপ বাড়ার চিত্র অজনা নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষক ও বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেসব এলাকায় যুদ্ধ চলছে, সেখানে মানবিক করিডর চালু হলে সামরিক সংস্পর্শ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।”

ফলে মানবিক করিডর দিয়ে শুধু ত্রাণ নয়, অস্ত্র ও মাদক পাচারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে, রোহিঙ্গা ও অভিবাসন বিশ্লেষক আসিফ মুনির করিডোরের ওপর বাংলাদেশের কতোটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

ডয়েচে ভেলেকে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “আরাকান আর্মি একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। তাদের সঙ্গে যদি সুস্পষ্ট সমঝোতা না হয়, তাহলে করিডোর ব্যবহারের ওপর বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।”

ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘের ভূমিকা

মানবিক করিডোর নিয়ে বাংলাদেশের সাথে জাতিসংঘের আলোচনা শুরু হয় ফেব্রুয়ারির শুরুতে, যখন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর মার্চে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফরের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে করিডোরের প্রস্তাব দেওয়া হয়।

জাতিসংঘ চায় বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছাক। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিসংঘ কাদের সাথে আলোচনা করে করিডোরের বাস্তবায়ন করবে- তা এখনও পরিষ্কার নয়। কারণ, আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সামরিক বাহিনী দুজনই রাখাইনে শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে সক্রিয় রয়েছে।

জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যে করিডোরের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে হতে পারে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশকে করিডর চালুর আগে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর (চীন, ভারত) সাথে সুস্পষ্ট সমন্বয় তৈরি করতে হবে এবং জাতিসংঘের সঙ্গেও একটি শক্তিশালী সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে যাতে করিডোর পরিচালনায় বাংলাদেশ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads