বাংলাদেশ ও বিশ্ব নিয়ে নিয়মিত লিখে আসছেন সিনিয়র সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ, যিনি সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন এনায়েতুল্লাহ খানের প্রখ্যাত সাপ্তাহিক হলিডে দিয়ে। এরপর সাংবাদিকতার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কাজ করে গেছেন কয়েকযুগ। সর্বশেষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসেবে। সাম্প্রতিককালে সোশাল মিডিয়ায় ‘মিডিয়া ওয়াচ’ শিরোনামে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিজের মতামত ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছেন এই অভিজ্ঞ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। পাঠকের জন্য তার সর্বশেষ লেখাটি হুবুহু তুলে দেওয়া হলো।
গত বছর এই মাসে ছাত্র জনতার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেটার বর্ষপূর্তিতে নানান হিসাব নিকাশ শুরু হয়েছে। আমি নিজেও এটা নিয়ে বেশ কিছুদিন থেকে চিন্তাভাবনা করছি।
কী পেলাম আর পেলাম না, সেটা মোটা দাগে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করছি।
এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সুফল হলো শেখ হাসিনার মত একটা নিকৃষ্ট স্বৈরশাসকের পতন। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনে হলো তারা নতুন করে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। অকপটে স্বীকার করি আমি নিজেও তার পতন হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্ধিহান ছিলাম। ছাত্রজনতাসহ আপামর জনগোষ্ঠী এই সাফল্যের দাবিদার।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গত ৮ আগস্ট ইউনূস সাহেবের দায়িত্ব গ্রহণ আমাদের সবাইকে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। তার মতো একজন সৎ, দেশ প্রেমিক বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন- এটা ছিল সবার প্রত্যাশা।
মাস দুয়েক পর এই প্রত্যাশা ম্লান হতে শুরু করে। এর কারণ ইউনূস সাহেব দেশের সার্বিক অবস্থার কথা বিবেচনা না করে খুব দ্রুত আমলাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এর পুরো সুযোগ নেয় দুর্নীতিবাজ, সুবিধাভোগী আমলারা। প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন ভেস্টেড ইন্টারেস্ট গ্রুপ তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে ঠিক একই উপায়ে চাপ সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
এর ফলশ্রুতিতে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং সীমাহীন নৈরাজ্যের শুরু দেখতে পাই। ১১ মাস পরেও পরিস্থিতির কোন উন্নতি তো হয়নি, বরং আরো অবনতি হচ্ছে দিন দিন।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো যদি ইউনূস সাহেব প্রথমেই একটা কঠিন বার্তা দিয়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন তবে সমস্যা এত জটিল হতো না।
ইউনূস সাহেব দেশের দায়িত্ব নেওয়ার দুদিন পর, অর্থাৎ ১০ ই আগস্ট, আমি তাকে উদ্দেশ্য করে একটা খোলা চিঠি লিখি। মোটা দাগে আমি দুটো জিনিসের উপর তাকে গুরুত্ব দিতে অনুরোধ করি।
আমি লিখেছিলাম স্যার, আপনি দয়া করে দুর্নীতির ব্যাপারে আপোষীন হবেন; এবং দ্বিতীয়টি ছিল, যে কোন মূল্যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আর এটা করতে হলে আপনাকে সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে যেন ক্ষমতাধররা অপরাধ করে কোনভাবেই পার না পেয়ে যায়। একই সঙ্গে বিচারবিভাগের উপর যেন কেউ হস্তক্ষেপ না করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। ক্ষমতাধররা যে পার পেয়ে যাচ্ছে, বসুন্ধরার লুটেরা, খুনি, ধর্ষণকারী মালিকরা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে আমি তাকে অনুরোধ করেছিলাম যে যেহেতু ক্ষমতাবানরা কখনোই তাদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করে না, তাই আপনি এটা করে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করবেন।
আমি খুব খুশি হয়েছিলাম যখন ১৩ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া প্রথম ভাষণে অঙ্গীকার করেছিলেন যে তিনি সহ উপদেষ্টা পরিষদের সবাই জনসমক্ষে তাদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করবেন। তিনি আরো বলেছিলেন সরকারে কর্মরত সব কর্মকর্তা, কর্মচারীদের এই হিসাব দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবে দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে আমিও ভীষণ আশান্বিত হয়েছিলাম।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে মাত্র দু’তিনজন ছাড়া আর কেউ তাদের সম্পদ প্রকাশ করেননি। ইউনূস সাহেব নিজেও করেননি। দেশের শীর্ষ শাসনকর্তা হিসেবে যদি তিনি এটা করতেন তবে অন্যান্যরাও বাধ্য হত তাদের সম্পদ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে।
আমি প্রায়ই ভাবি উনি এটা কেন করলেন না। বিভিন্ন সূত্রে খবর পাই দেশে-বিদেশে হয়তো তার অনেক সম্পদ আছে যেটা সাধারণ মানুষ জানে না। আর সেটা প্রকাশ হলে তার সম্পর্কে মানুষের ধারণা পাল্টে যাবে।
এবার আইনের শাসন প্রসঙ্গে আসি। ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে তিনি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করে নেন। এরপর একের পর এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে যত রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া যায় গ্রামীণ ব্যাংক এবং এটার অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে তার সবগুলোই তিনি করেছেন।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে তাহলে অন্যান্য স্বৈরশাসকদের থেকে তিনি তো ব্যতিক্রম কিছু না?
এরপর দেখলাম যে সমস্ত ছাত্ররা এই জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তারা একে একে নানা রকম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা বা তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া ছিল সবার কাম্য। কিন্তু সেটা নিয়ে কিছুই দেখলাম না।
আমার ধারণা ছাত্রদের নিবৃত্ত করার কোন নৈতিক অধিকার তার ছিল না। তাদেরকে কিছু বললে হয়তো তারা উল্টো তাকে বলতেন, স্যার আপনি নিজেও তো একই কাজ করছেন। অতএব আপনিও খান; আমরাও খাই। এরপর একের পর এক বিদেশ ভ্রমণ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে তার ইন্টেগ্রিটি সম্পর্কে। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী তিনি এ পর্যন্ত ১১ বার বিদেশ ভ্রমণে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন; যার পুরোটাই বহন করেছে এই দেশের সাধারণ ট্যাক্সপেয়ার। তিনি যদি সত্যিকার অর্থে সৎ এবং দেশপ্রেমিক হতেন তবে এ কাজগুলো তো তিনি কখনোই করতেন না।
আমি প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে এ ধরনের নেতিবাচক লেখা লিখছি কেন- এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে প্রায়ই। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, আমি ইউনূস সাহেব সম্পর্কে ভালো কথা বলি না কেন। তাদের বক্তব্য উনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি এবং তার সম্পর্কে নেতিবাচক কথা গ্রহণযোগ্য নয়।
সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়িত্ব হল ক্ষমতাধরদের প্রশ্ন করা এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। উনি যখন ক্ষমতার বাইরে ছিলেন তখন তো আমি এ সম্পর্কে কিছু বলিনি। কেউ ক্ষমতায় এসে যদি তার অপব্যাবহার করে, আইন কানুন না মেনে অবৈধভাবে নানান সুযোগ-সুবিধা নেয় তবে সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমি শুধু সেটাই করছি। এখানে আমার কোন ব্যক্তিগত লাভ লোকসান নেই।
এ সংক্রান্ত আরও খবর: