পথ দেখিয়ে দিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার, সেই পথে চলছে অন্যরাও। তবে সর্ষের চেয়ে বালি গরম বলে যে প্রবাদ রয়েছে, তা পুনরায় বুঝিয়ে দিয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কুষ্টিয়ার এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্র হলটি ছিল, তার নাম বদলে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। হলটির নাম এখন হয়েছে ‘শাহ আজিজুর রহমান হল’।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া কুষ্টিয়ার শাহ আজিজ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাই শুধু করেননি, পাকিস্তানের পক্ষে সাফাই গাইতে জাতিংঘেও গিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর দালাল আইনে গ্রেপ্তার হলেও পরে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পান। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর তাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর পর আবার এইচ এম এরশাদের সঙ্গেও ভিড়েছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজের নামে হলের নামকরণে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছে। বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদও জানাচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব নিয়ে ইউনূস বলেছিলেন, এ এক ‘নতুন’ বাংলাদেশ।
সেই ‘নতুন’ বাংলাদেশে শেখ হাসিনার গত দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবশেষ উৎপাটন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকেও মুছে ফেলার প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
অভ্যুত্থানের ছয় মাস পর গত মাসের শুরুতে ঘোষণা দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন। দুদিন ধরে ভাঙা চললেও ঐতিহাসিক এই বাড়িটি রক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার।
বরং বলেছিল, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছেন বলেই বাড়িটি আক্রান্ত হয়েছে।
এরপর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদ বঙ্গবন্ধু ও তার মেয়ে শেখ হাসিনাসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা দেশের ১৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে। অবশ্য িবশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম বদলালেও নতুন নাম হয়েছে এলাকার নামে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও হলসহ বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তনের হিড়িক পড়ে। তাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নাম যুদ্ধাপরাধী ফজলুল কাদের চৌধুরীর নামে করার প্রস্তাব আসে।
ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে হয়েছিল সেই বিচার।
ফজলুল কাদেরের নামে হলের নামকরণের প্রক্রিয়ার খবরে সমালোচনা ওঠার পর সেদিকে আর এগোয়নি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারা প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়।
কিন্তু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাম বদলে আরেক যুদ্ধাপরাধীর নাম হলের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছে। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ২৬৭তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সেই সিদ্ধান্তে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চারটি আবাসিক হল এবং একটি একাডেমিক ভবনের নাম পরিবর্তন হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পরিবর্তন করে ‘শাহ আজিজুর রহমান হল’ করা হয়েছে।

এছাড়া শেখ রাসেল হলের পরিবর্তে ‘শহীদ আনাছ’ হল, ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ হলের নাম পরিবর্তন করে ‘উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দিকা’ হল এবং শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন করে ‘জুলাই-৩৬’ হল রাখা হয়েছে। ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান ভবন’ নতুন নাম পেয়েছে ‘ইবনে সিনা বিজ্ঞান ভবন’।
শাহ আজিজ কে ছিলেন?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরেই অনুচ্চারিত শাহ আজিজের নাম। তবে এক সময় তিনি আলোচনায় ছিলেন, তবে নেতিবাচকভাবে।
জন্ম তার ১৯২৫ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে মথুরাপুর ইউনিয়নের কৈপাল গ্রামে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।
ছাত্রজীবনেই মুসলিম লীগে যুক্ত হন শাহ আজিজ। কাজ করতেন দলটির ছাত্র সংগঠনে। বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের সাথারণ সম্পাদকও ছিলেন তিনি।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব নেন শাহ আহিজ। পরে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদকও হন তিনি।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে এর বিরোধিতা করেছিলেন শাহ আজিজ। ১৯৬২ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে যোগ দেন তিনি।
পরে তিনি আওয়ামী লীগে ভেড়েন এবং অল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতিও হন। তবে ১৯৭০ সালে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃকত হন তিনি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় লীগের হয়ে কুষ্টিয়া-৩ আসনে প্রার্থী হয়ে হারেন শাহ আজিজ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানিদের পক্ষ নেন।
১৯৭১ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এ এম মালিকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে জাতিসংঘে যান। সেখানে তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে কোনো গণহত্যা চালায়নি। অন্যান্য মুসলিম দেশকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতেও আহ্বান জানান তিনি।
স্বাধীনতার পর দালাল আইনে ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো শাহ আজিজও গ্রেপ্তার হন। ফজলুল কাদের বন্দি অবস্থায় মারা গেলেও বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সাধারণ ক্ষমায় ১৯৭৩ সালে মুক্তি পান শাহ আজিজ।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসার পর মুসলিম লীগকে সক্রিয় করেন শাহ আজিজ। জিয়ার উদ্যোগে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন হলে তাতে যোগ দেন তিনি। এরপর বিএনপি গঠন করে তাকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করেন জিয়া।, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর পদেও বসান। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে কুষ্টিয়া-৩ আসন থেকে ভোটেও জেতেন তিনি।
জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ ক্ষমতায় বসলে তার রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন শাহ আজিজ। এরশাদের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে বিএনপিতে পুনরায় ফিরে আসার পরপরই তিনি মারা যান।
নামকরণের সমালোচনা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বঙ্গবন্ধুর নাম বদলে শাহ আজিজের নাম বসানোর ব্যাপক সমালোচনা চলছে ফেইসবুকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা এনিয়ে সরব হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অনি আতিকুর রহমান লিখেছেন, “জনগণের টাকায় তৈরি রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নাম হবে স্ব-স্ব স্থানের নামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের ক্ষেত্রেও তাই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু একাধিক হল বা ছাত্রাবাস থাকে, সেগুলোর নামকরণ হবে রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশের নানা পর্যায়ে ভূমিকা রাখা গুণীজনের নামে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্ম, সংস্কৃতির নানা অঙ্গনের গুণীজন স্থান পাবেন।
“রাজনৈতিক ক্যাটাগরি বিবেচনায় নিলে ভাসানী, শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ। এদের কাউকেই বাদ দিলে হিংসা জিইয়ে রাখা ছাড়া কিছুই হবে না। আজ শেখপাড়ার পাশের বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন যে কাজটা করেছে, এটা নিঃসন্দেহে ষড়যন্ত্র। এটা জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ফ্যাসিস্ট শক্তিকে এনাবল করার ষড়যন্ত্র।”
আরেক শিক্ষার্থী জি কে সাদিক লিখেছেন, “শাহ আজিজুর রহমান একজন চিহ্নিত রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী; বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার পক্ষে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এই লোক মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার পক্ষে কাজ করে গেছে।
“তার নামে আবাসিক হল, জুলাই অভ্যুত্থানের যে চেতনা, সেটার বিরুদ্ধে যায়।..‘জুতা নিক্ষেপ করে’ এমন কর্মের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে এর নিন্দা জানিয়ে রাখলাম।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম লিখেছেন, “ভাষা হারিয়ে ফেলেছি, আমরা বড়ই মুনাফেক।”
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আনোয়ার হোসেন লিখেছেন, “দেশের স্থপতিকে অসম্মান করে কোনো প্রতিষ্ঠান বড় হতে পারে না।”
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ; উজ্জ্বল লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম পাল্টিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া ব্যক্তির নামে হলের নামকরণের ব্যখ্যা কী? এটা দিয়ে কি প্রমাণ করতে চান আপনারা?
“আওয়ামী লীগের বিগত দিনের নামকরণের অসুস্থ, নোংরা সংস্কৃতির সঙ্গে আরও নতুন মাত্রাই যুক্ত হচ্ছে, আর কিছু নয়। এই সকল ঘটনার ফলাফল হবে একই রকম।”
ছাত্র ইউনিয়নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ এক বিবৃুতিতে এই নামকরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “শাহ আজিজুর রহমানের মতো একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীর নামে আবাসিক হলের নামকরণ জাতির জন্য এক কলঙ্কজনক সিদ্ধান্ত। একই সঙ্গে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাপরিপন্থী।
“মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানের নামে আবাসিক হলের নামকরণের মধ্য দিয়ে ইবি প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।”