বাংলাদেশের রাজনীতির দৃশ্যপট উল্টে যাওয়ার পর একুশের বইমেলায় দেখা গেল জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানকে। তিনি গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়ে।
শেষ কবে জামায়াতের শীর্ষ কোনো নেতাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গিয়েছিল? এর উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে ৩৪ বছর আগে। সেবার জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন মতিউর রহমান নিজামী।
তবে দুজনের যাওয়ার পরের ঘটনা পুরোপুরিই ভিন্ন; জামায়াত আমির নির্বিঘ্নে বইমেলার বিভিন্ন স্টলে ঘুরেছেন, নামাজও পড়েছেন সেখানে, কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গেও।
কিন্তু নিজামীর অভিজ্ঞতা এমন সুখকর ছিল না। ১৯৯১ সালের ২৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে গিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের মারধরের শিকার হয়েছিলেন নিজামী। তিনি তখন সংসদ সদস্য ছিলেন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পাশাপাশি গণহত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে থাকা জামায়াত স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নিষিদ্ধই ছিল।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের শামনামলে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয় দলটি। তবে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলো কখনও জামায়াতকে কিংবা তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে কখনো ক্যাম্পাসে মেনে না নেওয়ার অবস্থানে ছিল।
১৯৯১ সালে নির্বাচনে জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠনের দুই মাস পর ২৭ এপ্রিল ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসমুক্ত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক নেতাদের একটি সভায় ডেকেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা।

সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অপরাপর দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতও ডাক পেয়েছিল। দলটির প্রতিনিধি হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে বৈঠক করতে গিয়েছিলেন নিজামী। সেখানেই ছাত্রলীগ, জাতীয় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগসহ অন্য সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের পিটুনির শিকার হন তিনি।
পরদিন প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- দুপুর ১২টার দিকে নিজামী উপাচার্যের অফিসে পৌঁছনোর পরপরই ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে থাকে। সোয়া ১২টার দিকে জাতীয় ছাত্রলীগের একটি মিছিল উপাচার্যের অফিসের সামনে গিয়ে স্লোগান দিতে থাকে- রাজাকার নিজামীকে বের করে দিতে হবে। এরপর আরও সংগঠন সেখানো জড়ো হয়।
উপাচার্য তখন বোঝাচ্ছিলেন যে জামায়াতের সংসদে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে, সেই কারণে তাকে এই সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তখন ছাত্রনেতারা বলতে থাকেন, ছাত্রশিবিরকে তারা গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন হিসাবে মানেন না, ফলে এখানে নিজামীর আসার কোনো সুযোগ নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রনেতা তার কাটা হাত দেখিয়ে বলেন যে শিবির তার এই হাত কেটে দিয়েছে। আরেকজন ছাত্রনেতা বলেন, নিজামী খুনি, আল বদর বাহিনীর প্রধান হিসাবে একাত্তরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করিয়েয়েছেন। সুতরাং তার এখানে আসার কোনো অধিকার নেই।
ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এরকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা সভাকক্ষে ঢুকে পড়ে নিজামীর ওপর হামলা চালায়।
“বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা তাহার (নিজামী) প্রতি খাবার প্লেট, পেপারওয়েট ও চেয়ার ছুড়িয়া মারে। হামলার এক পর্যায়ে ভিসির চেয়ারের পাশে শিবিরের কতিপয় কর্মীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত নিজামীকে কাঁপিতে দেখা যায়।
“জনৈক তরুণ লম্ফ দিয়া প্রথমে নিজামীকে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে ৩০/৩৫ জন তরুণ তাহার ওপর চড়াও হয়। তাহার ওপর চলে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি। ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর, রেজিস্ট্রার, রাজনৈতিক নেতাগত ছাত্রদের থামাইতে গিয়া সবাই কম বেশি ধাক্কা খান। ভিসি দুই বার চেয়ার হইতে পড়িয়া যান।”
২০ মিনিট পর পুলিশ গিয়ে যখন নিজামীকে উদ্ধার করতে যায়, তখন তার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে, তার মুখ, গলা, মাথা রক্তাক্ত। নিজামীকে বাঁচাতে গিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও ছাত্রদের তোপের মুখে পড়েন।
এরপর বাকশালের তৎকালীন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের হস্তক্ষেপে ছাত্রদের হাত থেকে পুলিশ নিজামীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

তখন হাসপাতালে নিজামীকে দেখতে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০০১ সালে সরকার গঠনের সময় নিজামীকে মন্ত্রীও করেছিলেন তিনি। ততদিনে নিজামী জামায়াতের আমির হয়েছেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন নিজামী। ২০১৬ সালের ১১ মে নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার দণ্ড কার্যকর হয়।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে ১৯৭১ সালে জামায়াতের আমির গোলাম আযমেরও দণ্ড হয়েছিল। কারাদণ্ড ভোগের সময়ই মারা যান তিনি। ১৯৮১ সালে গোলাম আযমও বায়তুল মোকাররমে জুতাপেটার শিকার হয়েছিলেন।
একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও গোলাম আযমকে জামায়াত ভাষাসৈনিক হিসাবে দাবি করে থাকে। এই দাবির সপক্ষে তথ্য দেওয়া হয় যে ১৯৪৮ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরের সময় বাংলাকে মাতৃভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে স্মারকলিপিটি ডাকসুর তৎকালীন জিএস গোলাম আযমের হাত দিয়েই দেওয়া হয়েছিল।
যদিও পরে ভাষা আন্দোলনে গোলাম আযমের কোনো তৎপরতার খবর ইতিহাসে মেলে না। বরং তার এমন বক্তব্য পাওয়া যায় যে, বাংলার পক্ষে তার তখনকার অবস্থান ঠিক ছিল না।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে প্রতি বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজন করে বাংলা একাডেমি, যা গত কয়েক বছর ধরে একাডেমি প্রাঙ্গণের পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে হয়ে আসছে।
বৃহস্পতিবার সেই বইমেলায় দেখা যায় জামায়াতের বর্তমান আমির শফিকুর রহমানকে। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াত যেমন ডালপালা মেলছে, ছাত্রশিবিরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য হয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনে বলা হয়, সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় শফিকুর মেলায় ঢোকেন। প্রথমে তিনি বাংলা একাডেমির প্রবেশমুখের একটি স্টলে যান। সেখানে স্টলের কর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং পাঠকদের সঙ্গে আলাপ করেন।
বইমেলা প্রাঙ্গণের মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ার পর আরও কিছু স্টল ঘুরে দেখেন শফিকুর। বই কিনতেও দেখা যায় তাকে। পৌনে ৭টার দিকে মেলার মুক্তমঞ্চের সামনে গ্রাফিতি পরিদর্শন করেন তিনি। তারপর তিনি বেরিয়ে যান মেলা থেকে।
জামায়াত আমির বইমেলায় সাংবাদিকদের বলেন, “আমি এসেছিলাম বইমেলা দেখতে। আলহামদুলিল্লাহ, এখানে প্রত্যেকটি স্টলেই উপচেপড়া ভিড়, পাঠকদের ভিড়, ছোট-ছোট শিশুরাও এখানে চলে এসেছে।”
বইমেলায় তার সঙ্গে ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরীর (দক্ষিণ) আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েম, বর্তমান সভাপতি এস এম ফরহাদ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মু.আতাউর রহমান সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে এত বছর তো আমাদের বইমেলায় যাওয়ার পরিবেশ ছিল না। মূলত বই দেখা, সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করা, এটার জন্য তিনি মেলায় গিয়েছিলেন।
“আগে তো আমরা পরিবেশ পাইনি। এখন পরিবেশ হয়েছে; রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতেও তিনি অনেক জায়গায় যাচ্ছেন।”