দোহায় কি আসলে কিছু হয়েছে? সোশাল মিডিয়ায় চলছিল গুঞ্জন, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের সফর নিয়ে।
কাতারের রাজধানী শহরটি রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য হালে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে শফিকুর রহমানের দোহায় যাওয়ার খবরটি অনেকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি করে।
বিষয়টি এতদূর গড়ায় যে রবিবার জামায়াতকে বিবৃতি দিয়ে জানাতে হয়, খবরটি গুজব, শফিকুর রহমান কাতার যাননি।
তবে এই গুঞ্জনের মধ্যেই এদিন আদালত থেকে জামায়াতের নিবন্ধন ফেরত পাওয়ার রায় আসে। অর্থাৎ জামায়াত এখন দলীয় ব্যানারেই নির্বাচন করতে পারবে, আর বিএনপির দ্বারস্থ হতে হবে না।
অবশ্য প্রতীক হিসেবে দাঁড়ি পাল্লা থাকবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। কারণ আপিল বিভাগ সেই ভার ছেড়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে।
দোহা নিয়ে যে গুঞ্জন
গত কয়েক বছর ধরেই রাজনৈতিক বৈঠকের জন্য আলোচনায় আসছে দোহা। আফগানিস্তানে যখন তালেবানরা ক্ষমতায় আসেনি, তখন তাদের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা বৈঠক দোহাতেই হতো।
ফিলিস্তিনের প্রতিপক্ষ দলগুলোর সমঝোতা বৈঠকের কেন্দ্রও এই দোহা। গত মার্চেই দোহায় হামাস ও ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের নেতারা বৈঠক করেন।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যখন আর্থনা সম্মেলনে যোগ দিতে কাতার সফর করেছিলেন, তখন রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে একটি সম্মেলন আয়োজনে দোহা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা চেয়ে আসেন।
এরপর সম্প্রতি উত্তর-পূর্ব ভারতভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল নর্থ ইস্ট নিউজে সাংবাদিক চন্দন নন্দী বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের দোহায় অবস্থানের খবর দেন।
খলিল শুধু জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাই নন, তিনি প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
খলিলের সফরের খবর প্রকাশের মধ্যেই জামায়াত আমির শফিকুরের দোহা সফরের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের, যিনি অভ্যুত্থানের আগে-পরে নেপথ্যের নানা খবর প্রকাশ করে ছিলেন আলোচনায়, তিনি একটি ফেইসবুক পোস্টে শেয়ার করে কৌতূহল প্রকাশ করেন।
কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আল জাজিরার সঙ্গে কাজ করা শায়েরের শেয়ার করা সেই পোস্টে জামায়াত আমিরের পাশাপাশি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রাসি অ্যান জ্যাকবসনও ওয়াশিংটন থেকে দোহায় গেছেন বলে দাবি করা হয়।
ওই পোস্টে বলা হয়- “ডা. (শফিকুর রহমান) সাব, আশা করি দোহার মিটিং ভালো হয়েছে। আপনাদের হাইড অ্যান্ড সিক গেইমের হেতু বুঝলাম না। ট্রেইসিকে কেন ডিসি হয়ে দোহা আসতে হলো? আর আপনাকেই বা কেন এই বয়সে কষ্ট করে দোহা যেতে হলো? মাত্র ৮ জন মেহমান। তারা সরাসরি ঢাকায় আপনার মগবাজার অফিসে গেলে এমন কী হতো?”
দোহায় কথিত এই বৈঠকে অভ্যুত্থানকারীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে জামায়াতের ঐক্য, নির্বাচন পেছানোর বিষয়ে আলোচনা হয় বলে ইঙ্গিত করা হয় সেই পোস্টে।
যত বৈঠকই হোক না কেন, বঙ্গোপসাগর পাড়ে চীনকে টেক্কা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য সৃষ্টির প্রয়াত ফলপ্রসূ হবে না বলেও হুঁশিয়ার করা হয় সেই পোস্টে।
শনিবার থেকে এমন খবর ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়লে রবিবার জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম মাছুম বিবৃতি দিয়ে বলেন, হীন উদ্দেশ্যে জামায়াত আমিরকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
বিবৃতিতে গত কয়েকদিনে শফিকুরের নানা কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, জামায়াত আমির এই সময়কালে কাতারেই যাননি। তিনি িবদেশ গিয়ে থাকলে ইমিগ্রেশনে খবর নিলেই তা জানা যায়। ২৮ মে সকালে ঢাকার শাহবাগে সমাবেশে জামায়াত আমিরকে দেখা গেছে। দলীয় নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের যুদ্ধাপরাধের দণ্ড থেকে মুক্তি মেলায় সেই সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছিল।
জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়, ওই দিন দুপুরে মগবাজারের আল-ফালাহ মিলনায়তনে মতবিনিময় সভায় অংশ নেন শফিকুর। বিকালে গোলাম আযমের, সন্ধ্যায় আজিমপুর কবরস্থানে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও এ টি এম আজহারুল ইসলামের স্ত্রীর কবর জিয়ারত করেন তিনি।
২৯ মে বৃহস্পতিবার শফিকুর সারাদিন নিজ বাসায়ই ছিলেন বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।
বলা হয়, রাতে দলীয় কার্যালয়ে ছিলেন আমির। পরদিন ৩০ মে শুক্রবার ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করেছেন। সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে নির্বাহী পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন।
“২৯ ও ৩০ মে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আমিরে জামায়াতের প্রবেশ ও বৈঠকের সিসিটিভি ফুটেজ আমাদের অফিসে সংরক্ষিত রয়েছে; যে কেউ চাইলে তা যাচাই করে দেখতে পারেন।”
বিবৃতিতে বলা হয়, ৩০ ও ৩১ মে শুক্র ও শনিবার জামায়াতের রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের উদ্যোগে জেলা ও মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্যদের দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত শিক্ষাশিবিরের সমাপনী দিনে শফিকুর রক্তব্য রাখেন।
“৩১ মে আমিরে জামায়াত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সকাল ৭টায় সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং একই দিন সন্ধ্যা ৭টায় সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় অবতরণ করেন।”
নিবন্ধন ফেরার রায়
আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ বলে রায় দিয়েছিল হাই কোর্ট। আদালতের সেই আদেশ মেনে নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে নিবন্ধন বাতিল করলে জামায়াত নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে পড়ে।
তবে তাতেও জামায়াতের দল হিসেবে সক্রিয় থাকতে বাধা ছিল না। কিন্তু সেই পথ বন্ধ করতে ২০২৪ সালের আগস্টে সন্ত্রাসী দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে শেখ হাসিনার সরকার।
তবে এই নিষেধাজ্ঞা টেকেনি এক মাসও। ওই বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়।
এরপর দলীয় ব্যানারে ভোটে অংশ নিতে কাঁটা হয়ে থাকা আদালতের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করে জামায়াত।
সেই আবেদনের রায়ে রবিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ হাই কোর্টের আদেশ বাতিল করে দেয়।
ওই রায় মেনেই যেহেতু জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছিল ইসি, ফলে এখন দলটির নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে হবে। তবে দলীয় প্রতীক হিসেবে দাঁড়ি পাল্লা জামায়াত পাবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ইসির ওপরই দিয়েছে আদালত।
এক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে সুপ্রিম কোর্টের ২০১৬ সালে পাস হওয়া একটি রেজল্যুশন। যেখানে আদালতের প্রতীক দাঁড়ি পাল্লা নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য কোনো দলকে বরাদ্দ না দিতে ইসিকে বলা হয়েছিল।
একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের গঠনতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে ২০০৯ সালে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন হয়েছিল।
সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেয় হাই কোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ।
হাই কোর্টের রায়ের পরপরই তা স্থগিত চেয়ে জামায়াত আবেদন করেছিল। তা ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের তৎকালীন চেম্বার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী, যিনি অভ্যুত্থানের পর গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় জামায়াত ২০১৮ সালে নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে অংষ নিতে পারেনি। আমির শফিকুরসহ অন্য নেতারা প্রার্থী হয়েছিলেন বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে।
অভ্যুত্থানের পর বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির মধ্যে জামায়াত নিবন্ধন ফিরে পেতে তাদের দীর্ঘদিন আগে করা আবেদনের পুনঃশুনানির উদ্যোগ নেয়।
তাদের আবেদনে গত বছরের ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ তাদের আপিল পুনরুজ্জীবনের অনুমতি দিয়ে শুনানি শুরু করে। কয়েক দফা শুনানির পর রবিবার রায় হলো।
রায়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত আমির শফিকুর ফেইসবুকে লেখেন, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনসংক্রান্ত হাই কোর্টের দেওয়া ন্যায়ভ্রষ্ট রায় আজ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ বাতিল ঘোষণা করেছে।
“পরবর্তী প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মহান রবের সাহায্য চাই—আমরা যেন দ্রুতই আমাদের পূর্ণ অধিকার ফিরে পাই।”