বাংলাদেশে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে। চাকরি হারানোর ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা চলছে দেশটির গণমাধ্যম কর্মীদের মাঝে।
অভিযোগ উঠেছে, ‘ভয়ে’ সেলফ সেন্সরের পথ বেছে নিতে হচ্ছে গণমাধ্যম কর্মীদের।
সর্বশেষ ‘হুমকির মুখে’ একটি বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশনের পাঁচ সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির পর রীতিমতো ‘আতঙ্কগ্রস্ত’ গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা।
গত ১৭ ডিসেম্বর বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন সময় টিভির কার্যালয়ে ঢুকে প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন সাংবাদিককে বরখাস্ত করার ‘নির্দেশ’ দেয় বৈষম্যবিরাধী ছাত্র আন্দোলন নামে একটি সংগঠনের একদল নেতাকর্মী, যাতে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
তারা প্রতিষ্ঠানটির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে এই বলে শাসায় যে, ওই সাংবাদিকরা বিগত সরকারের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন।
পরে তাদের নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ সাংবাদিককে বরখাস্ত করা হয় বলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
এর আগে আগস্টের শেষ সপ্তাহে চাকরিচ্যুত করা হয় একই প্রতিষ্ঠানের আরও দুই জনকে।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসনাত আব্দুল্লাহ বার্তা সংস্থা এএফপি’র কাছে দাবি করেন, “সময় টেলিভিশন মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে, তার মন্তব্যকে বিকৃত করে প্রকাশ করেছে এবং পতিত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে।
“আমরা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাকে সমর্থন করি, তবে সংবাদ মাধ্যমকে অবশ্যই নিরপেক্ষ থাকতে হবে।”
তাদের ‘দাবির’ মধ্যে হাসনাত ‘কোনো সমস্যা দেখছেন না’ মন্তব্য করলেও বরখাস্ত করার জন্য কোনো তালিকা দেওয়া হয়েছে- এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।
ঘটনার বিষয়ে সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সময় টিভির পরিচালক মো. হাসানের সঙ্গে কথা বলেছে এএফপি।
মো. হাসান জানান, সমন্বয়ক পরিচয়ে কয়েকজন তার সঙ্গে দেখা করে মৌখিকভাবে কয়েকজনের নাম জানায়। “ওনারা বলেন যে এদেরকে এখানে রাখা যাবে না,” যোগ করেন তিনি।
সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুতির অভিযোগটি ‘সত্য’ বলে জানিয়েছেন সময় মিডিয়া লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোরশেদুল ইসলামও।
তিনি বলেছেন, “সিটি গ্রুপের এমডিকে তারা ভয়টা দেখিয়েছে। ওখান থেকে আমাদের চাপ দেওয়া হয়েছে যে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য, যে কারণে আমরা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছি। স্বেচ্ছায় আমরা এটা করি নাই।”
চাকরিচ্যুতদের একজন চিফ ইনপুট এডিটর ওমর ফারুকের বক্তব্যও শুনেছে এএফপি।
প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তাদেরকে সরে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা এই পদক্ষেপের কারণ ব্যাখ্যা করতে বলেছিলাম, তবে তারা অপারগতা পোষণ করেছেন।”
অবশ্য শুক্রবার ফেইসবুকে দেওয়া এক পোস্টে পুরো ঘটনাটিকে নিজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন হাসনাত। তিনি দাবি করেন, তিনি কোনো তালিকা দেননি, কাউকে চাকরিচ্যুত করতে চাপও দেননি।
বিগত সরকারের আমলেও অধিকার আদায়ে বিভিন্ন সময় রাস্তায় নামতে হয়েছে গণমাধ্যম কর্মীদের। হুমকি-ধমকির মতো ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য।
৫ আগস্ট সেই সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশনে হামলা ও আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। কয়েকটি পত্রিকা অফিসও হয়েছে আক্রান্ত।
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা হয়েছে হত্যা মামলা, গ্রেপ্তারও হয়েছেন অনেকে। অভিযোগ- এসব গণমাধ্যম কর্মী বিগত সরকারের হয়ে কাজ করেছেন।
“প্রফেসর ইউনূস সাহেব বলেছেন আপনারা লিখুন, কিন্তু আমরা কী লিখতে পারছি? সেলফ সেন্সরশিপে আমরা একদম কাবু হয়ে পড়েছি। এখান থেকে আমরা বের হতে পারছি না।”
এছাড়া বাতিল করা হয় ১৬৭ জন সাংবাদিক ও সম্পাদকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড, যা নিয়ে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডারের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান সেলিয়া মেরসিয়ের।
বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারকে ‘বন্ধ করে দেওয়ার দাবিতে’ তাদের কার্যালয়ের সামনে মিছিল ও বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে গেল মাসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাঁজোয়া যান পর্যন্ত নামাতে হয় ঢাকার রাস্তায়।
অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস প্রায় নিয়মিতই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে আসছেন।
তার প্রেস সচিব যদিও এ ধরনের পদক্ষেপের দায় সংশ্লিষ্টদের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, কেউ যদি কোনো পদক্ষেপ নেয় সে দায়িত্ব তার উপরই বর্তাবে।
গণমাধ্যমে এরকম প্রতিকূল পরিবেশের কথা উঠে এসেছে প্রবীণ সাংবাদিকদের বক্তব্যেও।
সম্প্রতি সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ-গণমাধ্যম প্রসঙ্গ’ শীর্ষক সংলাপে অংশ নিয়ে মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী প্রশ্ন রেখে বলেন, “প্রফেসর ইউনূস সাহেব বলেছেন আপনারা লিখুন, কিন্তু আমরা কী লিখতে পারছি?
“সেলফ সেন্সরশিপে আমরা একদম কাবু হয়ে পড়েছি। এখান থেকে আমরা বের হতে পারছি না।”
ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কেবল চলতি বছরেই ১৫০ জনেরও বেশি টেলিভিশন সংবাদকর্মী চাকরিচ্যুত হয়েছেন। এছাড়া চাকরি গিয়েছে সংবাদপত্র কর্মীদেরও।