অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যখন লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলের সামনে গাড়ি থেকে নামলেন, তখন তাকে অভ্যর্থনা জানালেন খলিলুর রহমান।
হোটেল লবি দিয়ে ইউনূসের কক্ষ পর্যন্ত তারেক রহমানকে নিয়ে যান তিনি। পথে বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে তারেককে পরিচয়ও করিয়ে দিচ্ছিলেন, যার ভিডিও প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে দেওয়া হয়েছিল, পরে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এরপর যখন ইউনূস-তারেক বৈঠকে বসেন, তখনও খলিল সেখানে ছিলেন; এছাড়া ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। দুজনের একান্ত বৈঠকে তারা কেউ ছিলেন না।
বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রেস সচিবের সঙ্গে খলিলও আসেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। যৌথ বিবৃতি খলিলই পড়ে শোনান।

যে খলিলকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি, সেই দলের নেতার সঙ্গে বৈঠকে তাকেই কেন রাখলেন ইউনূস? এই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
বিতর্কিত এক চরিত্র খলিলকে গত বছরের নভেম্বরে দেশে এনে নিজের রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে নিয়োগ দেন ইউনূস। তার চার মাস আগে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফ্রান্স থেকে উড়ে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নেন ইউনূস।
যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা খলিল নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দুই যুগ আগে বাংলাদেশ ছাড়ার পর এবার ঢাকায় ফিরেই ইউনূস প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়েও নাক গলাতে থাকেন।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিদেশে অবস্থানকালে গত এপ্রিলে খলিলকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে বসান ইউনূস।
মিয়ানমারের রাখাইনে বাংলাদেশ দিয়ে করিডোর স্থাপনে সবচেয়ে বেশি তৎপর খলিল। এতে আপত্তি জানানোয় পররাষ্ট্র সচিব জসীমউদ্দিনকে পদ হারাতে হয়।
তবে তখনই খলিলকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ নিয়ে এসেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
খলিল জাতিসংঘের ত্রাণ সহায়তা পৌঁছতে করিডোরের কথা বললেও বিশ্ব সংস্থাটির প্রতিনিধি যখন এবিষয়ে কিছুই না জানার কথা বলেন, তখন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রশ্ন করেন- “খলিল সাহেবকে এবং সরকারকে জবাব দিতে হবে, তারা আসলে কার জন্য কাজ করছেন?”
এরমধ্যে চাউর হয় খলিল যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। সেকথা অস্বীকার করতে গিয়ে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জড়িয়ে মন্তব্য করলে বিএনপি তাকে সরানোর দাবি তোলে।

গত ২৪ মে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি নেতারা যে কয়টি দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে আসেন, তার মধ্যে খলিলকে সরানোর বিষয়টিও ছিল।
সেইদিন বিএনপির প্রতিনিধি দলে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান ও সালাহউদ্দিনের সঙ্গে আমীর খসরুও ছিলেন। তারা খলিলকে সরানোর দাবি লিখিতভাবেও দিয়ে এসেছিলেন।
সেই আমীর খসরুই শুক্রবার লন্ডনে খলিলের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করলেন। শুধু তাই নয়, প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে ইউনূস-তারেক রহমানের বৈঠকের পাশাপাশি খলিল ও আমীর খসরুর আলোচনা করার আলাদা একটি ছবিও পোস্ট করা হয়েছে।
যে ছবিতে ইউনূস নেই, সেই ছবি প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে দেওয়ার নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোনো কারণ রয়েছে; যদিও সেই কারণটি উহ্যই থেকেছে। এরপর যৌথ সংবাদ সম্মেলনেও আমীর খসরুর পাশে বসেন খলিল।
যে তারেক রহমানকে নিয়ে মন্তব্যের জন্য খলিলকে নিয়ে আপত্তি বিএনপির, তাকে দিয়ে তারেককে অভ্যর্থনা জানানো, আবার তাকে আমীর খসরুর সঙ্গে বৈঠকে বসানো অনেকের মনেই কৌতূহল তৈরি করেছে।
বিষয়টি নজরে এসেছে বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামালের। তিনি এক টিভি টকশোতে এই প্রসঙ্গ ধরে বলেন, ইউনূস এর মধ্য দিয়ে বিএনপিকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি যা চান সেটাই হবে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, লন্ডনের এই বৈঠকে তাদের ইচ্ছা ছিল না, অন্তর্বর্তী সরকারের চাপাচাপিতেই তারেক আলোচনায় বসেন ইউনূসের সঙ্গে।
একান্ত বৈঠকে দুজনের কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জানা সম্ভব নয়। তবে বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়, তারেক রহমান ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছেন। তা শুনে ইউনূস বলেছেন, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও সব প্রস্তুতি সারা গেলে তা এগিয়ে ফেব্রুয়ারিতে আনা যেতে পারে।
এই নির্বাচনের সময় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে ইউনূস সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। ইউনূস বরাবরই বলছিলেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, নির্বাচন ডিসেম্বরেই করতে হবে। এক পর্যায়ে গত কোরবানির ঈদের আগে ইউনূস বলেন, নির্বাচন হবে এপ্রিলে। তখন বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করে।
কিছু দিন আগেই বিএনপির এক আলোচনা সভায় তারেক নির্বাচনের সময় নিয়ে টালবাহানায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য থাকার সন্দেহ পোষণ করে দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, নির্বাচন ডিসেম্বরে হতেই হবে।

লন্ডনের বৈঠকে এক ধরনের সমঝোতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও সেখানে বিএনপিইকে ছাড় দিতে হচ্ছে বলে অনেকের পর্যবেক্ষণ।
কেননা যৌথ বিবৃতির ভাষা অনুযায়ী, তারেক একবারও ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা তোলেননি। বরং তিনি নিজেই ফেব্রুয়ারির কথা বলেন।
“জনাব তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন, ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।”
ফলে আলোচনায় এপ্রিল ও ডিসেম্বর নিয়ে দর কষাকষির পর এপ্রিল ঠিক হয়েছে, সেটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
আর ইউনূস ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত করেছেন, তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ যৌথ বিবৃতির ভাষা এমন- “প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে।”
তার মানে এখানে কিন্তু থেকে যাচ্ছে। কিন্তু সেটাও তারেক মেনে নিয়েছেন বলে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে খলিল জানান।
তিনি বলেন, “জনাব তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার এই (নির্বাচন নিয়ে) অবস্থানকে স্বাগত জানান এবং দলের পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টাও জনাব তারেক রহমানকে ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য ধন্যবাদ জানান।”
তাহলে ফলপ্রসূ আলোচনার ফল কার দিকে যাচ্ছে? সাংবাদিক মাসুদ কামালের মতে, তা অন্তত বিএনপির পক্ষে যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, বিএনপি হয় এখানে উদারতার পরিচয় দিয়েছে, নয়তো নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে।
অর্থাৎ খলিলকে সঙ্গে রেখে ইউনূস যেমন বুঝিয়ে দিলেন বিএনপিকে, তেমনি নির্বাচনের দিন নিয়ে বিএনপিকে তার অবস্থান থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দিলেন তিনি, তবে নিজের অবস্থানে অস্পষ্টতা রেখেই দিলেন।
এ সম্পর্কিত আরও খবর: