মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের বাঁক বদল হচ্ছে, তাতে রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশমুখী। বাংলাদেশেও পাল্টেছে রাজনীতির দৃশ্যপট। তাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে রোহিঙ্গা সঙ্কট।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গত কয়েক বছর ধরেই চলছে গৃহযুদ্ধ। তাতে সামরিক সরকারের বাহিনী ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। শেষ খবরে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্য রাখাইন এখন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির করায়ত্ত।
এই রাখাইনেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাস। বৌদ্ধ নেতৃত্বাধীন আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের বিরোধ রয়েছে। এর পাশাপাশি আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়তে তাদের কাজে লাগিয়েছে সেনাবাহিনী। ফলে রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবেই আরাকান আর্মির চক্ষুশূল।
এই পরিস্থিতি গত কিছুদিন ধরেই কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা আসার খবর পাওয়া যাচ্ছিল স্থানীয়দের তরফে; যদিও সরকারি কর্মকর্তারা তা স্বীকার করছিলেন না।
তবে এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ইউনূসের কাছ থেকে জানা গেল, গত কিছু দিনে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা এখন মিশর সফরে রয়েছেন। সেখানে মালয়েশিয়ার উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী জাম্বরি আবদুল কাদিরের সঙ্গে বৈঠকে তিনি সংখ্যটি উল্লেখ করেন বলে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস জানিয়েছে।
ইউনূস বলেন, “রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতার পর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন করে ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।”
হিসাবটি কত মাসের বোঝা যায়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আছে পাঁচ মাস হলো। এর প্রায় পুরোটা সময়জুড়েই নাফ নদীর ওপারে রাখাইনে সংঘাত-বিস্ফোরণের আঁচ কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে পাওয়া যাচ্ছিল। সেই সংঘাতের কারণে বাংলাদেশিদের নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে, সেন্ট মার্টিনে নাফ হয়ে চলাচলও করা যাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছিল রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে। কিন্তু তা কার্যকর করতে পারেনি। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিয়েছে, মিয়ানমার সরকারও রাখাইনে কর্তৃত্ব হারিয়েছে।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সরকার সতর্ক রয়েছে বলে গত সেপ্টেম্বরে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
তিনি বলেছিলেন, “এটা কীভাবে ঠেকানো যায়, সেটা আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”
নতুন করে রোহিঙ্গা নেওয়ার পক্ষপাতি অন্তর্বর্তী সরকার নয় জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “নীতিগতভাবে আমরা কোনও রোহিঙ্গাকে নতুন করে আশ্রয় দেব না, যদিও দুঃখ লাগে কথাটা বলতে; কিন্তু আমাদের জন্য সাধ্যের অতীত, আর পারব না তাদের আশ্রয় দিতে।”
২০১৭ সালে শেখ হাসিনার সরকারও রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলতে প্রথমে চায়নি। কিন্তু নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে না চাওয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমালোচনা শুরু করলে সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য পরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন শেখ হাসিনা; যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার তিনি রোহিঙ্গাদের আর ঢুকতে না দেওয়াার পক্ষে অবস্থান নেন।
এখন নতুন করে সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল নামলে সীমান্ত বন্ধ রাখা সিদ্ধান্ত নেওয়া ড. ইউনূসের জন্যও ব্যক্তিগতভাবে কঠিন হবে। কারণ শান্তিতে নোবেলজয়ী হিসাবে তার সেই ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমাদের সমালোচনায় পড়বে।
নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে কয়েক মাসেই ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এর আগে থেকে ছিল ৩ লাখের মতো। তবে রোহিঙ্গাদের ঘরে নতুন সন্তান আসায় সংখ্যাটি এখন ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
এই রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই আছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে। কিছু রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নেওয়া হয় কয়েক বছর আগে।
শরণার্থী হিসাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে কূটনীতিকরা আগে থেকে বলে আসছেন। তারা তাই নতুন করে শরণর্থী নেওয়ার বিপক্ষে।
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক সম্প্রতি ডয়চে ভেলে বাংলাকে বলেন, “রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। এমনিতেই তারা নানা সঙ্কট তৈরি করছে ক্যাম্পে। সেখানে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা হচ্ছে। নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আশ্রয় নিচ্ছে।
“এখনই এই সমস্যা সমাধানের হাইটাইম। সরকারের উচিৎ কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করা। আমরা আর কোনোভাবেই নতুন রোহিঙ্গা নিতে পারবে না।”
সাবেক আরেক কূটনীতিক এস এম রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, “রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবসনই একমাত্র সমাধান। আর কোনও সমাধান নাই। প্রয়োজনে আমাদের আরাকান আর্মির সাথে ভিন্ন চ্যানেলে কথা বলতে হবে। আর আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সাথে দৃশ্যমান শক্তি দেখাতে হবে।”
এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সঙ্কটের ভার এককভাবে না নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রস্তাব করেছেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর কাছে সে বিষয়ে সমর্থনও আশা করেছেন।
বাসসের প্রতিবদন অনুযায়ী ইউনূস বলেন, তিনি এ সহিংসতা-জর্জরিত অঞ্চলকে সহায়তার প্রয়াসে রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত লোকদের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়েও তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।