বেরিয়ে আসছে খলিলের আরও গোমর

khalilur-rahman-nsa-bangladesh-1

২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাটের গ্রিনউইচের একটি স্কুল প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের পরিচালনা পর্ষদে নতুন তিনজনকে যুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। সেই তিনজনের একজনের নাম খলিল রহমান।

তিনি যে বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, তা নিশ্চিত হওয়া যায় সেই প্রেস রিলিজে খলিলের জীবনী দেখে।

ইন্টারনেট ঘাঁটলে এখনও গ্রিনউইচ সিটির হুইটবি স্কুলের সেই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি পাওয়া যায়। অর্থাৎ খলিলুর রহমান, যিনি রজার রহমান মুখোশে ফেইসবুকে সক্রিয়, যুক্তরাষ্ট্রে তার আরেকটি নামও পাওয়া গেল এই সূত্রে। আর সেই সঙ্গে জানা গেল, খলিলের দুই নাতি-নাতনি হুইটবি স্কুলেই পড়াশোনা করেন।

ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সূত্র ধরে ভারতের নর্থ ইস্ট নিউজ অনুসন্ধান চালিয়ে খলিলের বিভিন্ন দাবির আরও ফাঁক পেয়েছে। নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা বিষয়ের বাংলাদেশে তাকে নিয়ে তো এরই মধ্যে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পছন্দে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আসা খলিলের আসল মিশন কী, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।

সে কথায় আসার আগে দেখা যাক হুইটবি স্কুল খলিলের জীবনীতে কী লিখেছে। সেখানে লেখা হয়েছে- “খলিল ঢাকার একটি নেতৃস্থানীয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং বোর্ড অফ ট্রাস্টির সদস্য। তিনি ২০০৬ সালে জাতিসংঘ থেকে অবসর নেন। সেখানে তিনি ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন, যার মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের নির্বাহী কার্যালয়ে অর্থনৈতিক বিষয়ক প্রধান এবং আঙ্কটাডের বেশ কয়েকটি উদ্যোগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।”

খলিল সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, “তিনি ১৯৭৮ সালে আমেরিকান এক্সপ্রেস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকে একজন নির্বাহী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। পরের বছর তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন এবং পরে মহাপরিচালক পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৮৩ সালে (যুক্তরাষ্ট্রের) টাফটস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অফ ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি থেকে আইন ও কূটনীতিতে এমএ এবং অর্থনীতিতে পিএইচডি করেন। তার আগে তিনি ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ডিগ্রি নেন।”

হুইটবি স্কুলের এই জীবনীর সঙ্গে যদি গত ৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের ফেইসবুক পোস্টে প্রকাশিত খলিলের জীবনী তুলনা করা হয়, তাহলে কয়েকটি ফাঁক বেরিয় আসে।

প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পোস্টে বলা হয়- “খলিলুর রহমান ১৯৭৭ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে ১৯৭৯ সালে বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।”

তার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে সেই পোস্টে বলা হয়, “১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন তিনি। ১৯৮০-৮৩ সালের মধ্যে তিনি টাফটস ইউনিভার্সিটির ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি, কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন করেন এবং আইন ও কূটনীতিতে এমএ এবং অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।”

টাফটস ইউনিভার্সিটিতে খবর নিয়ে নর্থ ইস্ট নিউজ ১৯৮৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির ১২৭তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের নথি পেয়েছে, যেখানে এম খলিলুর রহমানের “বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এর বণ্টন : জননীতির উন্নয়নমূলক কমর্মকাণ্ডের ময়নাতদন্ত’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার কথা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসচুসেটস রাজ্যের টাফটস ইউনিভার্সিটি থেকে এম খলিলুর রহমান এমএ ডিগ্রি ডিগ্রি নিয়েছে, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এই তথ্য জানার পর নর্থ ইস্ট নিউজ প্রশ্ন তুলেছে- তাহলে কি টাফটস ইউনিভার্সিটিতে দ্বিতীয় এমএ ডিগ্রি নিয়েছিলেন খলিল? তিনি কি ১৯৮৩ সালে পিএইচডি ছাত্র তা করেছিলেন? এর মধ্যে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি কী করে এল?

যুক্তরাষ্ট্রের নামি বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুলে পড়াশোনা খলিল করেছিলেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের এর আগে ফেইসবুকে লিখেছিলেন, “শুইন‍্যেছিলাম ভদ্রলোক নাকি কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট হার্ভার্ডের থিকা এম এ ইন ল‍্য এন্ড ডিপ্লোমেসি কইরেছেন। কিন্তু কোথাও তো এমন কিছু খুঁজে পেলুম না।

“খলিলুর রহমান সাহেব, আপনি কি মিছা কথা কইছেন? হার্ভার্ডের সার্টিফিকেটটা একটু দেখাইবেন পিলিজ? আমরা খুইজ‍্যে ওবামা আর তার বাপরেও বাইর কইরেছি, কিন্তু আপনারে পেলুম না কেনে? বি. দ্র. নামের ভ‍্যারিয়েশন পরিবর্তন করেও দেখেছি, যেমন Kalil, Kali, Kolil করেও দেখেছি, কিছ‍্যু নাই।”

নর্থ ইস্ট নিউজ লিখেছে, এখন দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রথমত, খলিলুর রহমান সর্বনিম্ন পাঁচ বছরের কম সময়ে, তিন বছরে, পিএইচডি ডিগ্রি নেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ডেও অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। তিনি ১৯৭৯ সালে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার এক বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে একসাথে দুটি ডিগ্রি নেন, যা একটি অসাধারণ কৃতিত্ব! কিন্তু সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে একবছর বাধ্যতামূলক শিক্ষানবিশ সময়কাল পার করার আগেই তিনি কেমন করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারলেন, সেটচা একটি বড় প্রশ্ন।

বিমসটেক সম্মেলনে মুহাম্মদ ইউনূসের পাশেই বসেন খলিলুর রহমান।

রজার রহমানের খবর তো আগেই মিলেছে, এখন খলিলুর রহমান, খলিল রহমান এবং খলিলুর ডি রহমান- এমন তিনটি পরিচয় খলিল ব্যবহার করছেন বলে জানা যাচ্ছে এখন।

বাংলাদেশে বিএনপি এরই মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদ থেকে খলিলকে সরানোর দাবি তুলেছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকেও তা জানিয়ে এসেছে।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন গত ২৮ মে এক আলোচনা সভায় বক্তব্যে বলেন, “একজন উপদেষ্টা ২০ বছর বিদেশে ছিলেন। এখন বাংলাদেশ উদ্ধার করতে এসেছেন!

“তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আর কী কী পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন, আল্লাহ মালুম।”

বাংলাদেশে অচেনা খলিলকে গত নভেম্বরে নিজের রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাইরিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে নিয়োগ দেন ইউনূস। কিছু দিনের মধ্যে তিনি ইউনূস প্রশাসনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।

তারপর গত এপ্রিলে তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করা হয়। তা নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের অসন্তোষের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সেনাপ্রধানের বিদেশ সফরের সময়ই খলিলকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে বসানো হয়েছিল।

খলিলকে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপ স্টেটের পাঠানো প্রতিনিধি হিসেবে দেখেন কেউ কেউ। জুলকারনাইন শায়েরের দাবি, খলিল ‘ছোটন গ‍্যাং’ এর সদস‍্য।

এক সময়ের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন ২০০১-০৬ সালে বিএনপির কাণ্ডারি তারেক রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। শফিক রেহমানের যায়যায়দিন পত্রিকা মূলত তিনিই চালাতেন। ফরহাদ মজহারের সঙ্গেও ছোটনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

ছোটনের স্ত্রী ছিলেন অ্যাকশন এইডের আবাসিক পরিচালক নাসরিন হক। তিনি নিজের বাড়িতে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন। নাসরিন হকের বোন শিরীন হক বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান। তার স্বামী প্রয়াত জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ‘ছোটন গ্যাং’র বড় প্রভাব রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন জুলকারনাইন শায়ের। তার ভাষ্যে, সেই প্রভাবেই খলিল ঢুকেছেন ইউনূস প্রশাসনে।

খলিলের যুক্তেোষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেছিলেন, “একজন বিদেশি নাগরিককে আপনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা করেছেন। সেই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে আপনি বিদায় করুন।”

খলিলকে নিয়ে আলোচনার মধ্যে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আরশাদ মাহমুদ ফেইসবুকে তার নানা কাণ্ড-কীর্তির কথা তুলে ধরেন।

হঠাৎ করে ২০০১ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে খলিলের দেশে প্রত্যাবর্তন এবং তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের একান্ত সচিব হিসেবে তার যোগদানের কথা বলেন আরশাদ। তখন খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, খলিল হচ্ছেন লতিফুর রহমানের ভায়রা ভাই।

খলিলুর রহমানের এই ছবিটি এক যুগ আগের।

২০০১ সালে তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে নিয়োগ পাওয়ার মাস খানেকের মধ্যেই সচিবালয়ের এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে খলিলের সম্পরের্কে জড়িয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার খবরও লিখেছেন আরশাদ মাহমুদ।

তার ভাষ্যে, “খলিল ওই মহিলাকে আরো নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য নিউ ইয়র্ক মিশনে তাকে বদলির ব্যবস্থা করে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের পর খলিলও নিউ ইয়র্কে চলে যাবে।

“এতে ঘোর আপত্তি জানায় মহিলার স্বামী এবং এটা নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হত। যখন মহিলা দৃঢ়ভাবে জানায় সে নিউ ইয়র্কে চলে যাবে, তখন তার স্বামীর সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে তার স্বামী মহিলাকে গুলি করে এবং নিজে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পরপরই খলিল দ্রুত দেশ থেকে পালিয়ে যায় এবং আমার জানামতে সে আর কখনও আসেনি।”

এত আলোচনার মধ্যে থাকা খলিল তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগই করে আসছেন। তিনি দাবি করছেন, তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেই। তিনি কেবল বাংলাদেশেরই নাগরিক।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন