নিহতের ঘটনায় চারদিনেও মামলা নেই, পুলিশের মামলায় শিশুসহ গ্রেপ্তার ২৭৭

শনিবার জীবিকার তাগিদে পথে নামলেও ফাঁকা শহরের রিকশাও ছিল যাত্রীশূন্য।
শনিবার জীবিকার তাগিদে পথে নামলেও ফাঁকা শহরের রিকশাও ছিল যাত্রীশূন্য।

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশ ঘিরে সংঘাতের পর চতুর্থ দিনে গড়াল কারফিউ। সেদিনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৭৭ জনকে, যাদের ১৭৭ জনকে জেলা কারাগারে এবং বাকিদের পাশের জেলা পিরোজপুর ও বাগেরহাটে পাঠানো হয়েছে।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে অন্তত ৯ শিশুকে যশোরের পুলেরহাট শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর কথা রয়েছে।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সড়ক অবরোধ ও মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়ার ঘটনায় একটি মামলায় ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করা হয়েছে। একই মামলায় নাম উল্লেখ না করে আরও তিন শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।

শুক্রবার রাতে গোপালগঞ্জের বৌলতলী পুলিশ ফাঁড়ির এসআই শামীম আল মামুন বাদী হয়ে সদর থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলাটি করেন।

মামলায় ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছেন সদর থানার ওসি মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান।

শুক্রবারের মামলাটিসহ ১৬ জুলাইয়ের সংঘাতের ঘটনায় গোপালগঞ্জ সদর, কাশিয়ানী ও কোটালীপাড়া থানায় মোট চারটি মামলা হলো, যেগুলোতে মোট আসামির সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। মামলায় যে ৩৫৪ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে তারা সবাই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।

গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। সেখানে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও স্থানীয়দের উপর সেনাবাহিনী ও পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে ঘটনাস্থলে বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। সরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ৫ জন বলা হলেও সংখ্যাটি আরও বেশি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

নিহত ৫ জনের মধ্যে ঘটনার দিন নিহত চার জনের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে সমাহিত করতে বাধ্য করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যান্য ঘটনায় মামলা হলেও নিহতের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।

গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মীর মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান জানিয়েছেন, পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নিহত পাঁচ জনই সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে অভিযোগ ওঠেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে, তাদের সবার শরীরে গুলি ছিল।  

পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তবে…

সংঘাতের পর ঘোষণা করা কারফিউ শনিবার রাতে চতুর্থ বারের বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে জেলাটিতে চলমান অভিযান এবং জরুরি অবস্থা চতুর্থ দিনে গড়িয়েছে।

যদিও জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন সরকারকে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা লিখেছে, ওই জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে ‘দুষ্কৃতিদের’ খোঁজে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

দ্য সান ২৪ এর প্রতিবেদক সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানিয়েছেন, বেশিরভাগ বাড়িঘর পুরুষশূন্য অবস্থায় রয়েছে। সবার মধ্যে হয়রানির আতঙ্ক কাজ করছে।

সেলিম খান নামে একজনের সঙ্গে দুপুরে তার বাড়ির ওঠোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। পেশায় দিনমজুর সেলিম জানিয়েছেন, ওই ঘটনার সঙ্গে তার মতো অনেকেরই ন্যূনতম সম্পর্ক নেই, অথচ গত চারদিন ধরে তিনি যেমন কাজে যেতে পারছেন না, তেমনি ভয়ে ঘরেও থাকছেন না।

স্থানীয়দের অনেকেই বলেছেন, কারফিউর মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে মূলত লাশের সংখ্যা নিয়ে যেন মুখ খুলতে না পারে সেজন্য। তাদের আশঙ্কা, মোট ৫ জনের নিহত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হলেও প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েকগুণ।

১৬ জুলাইয়ের ঘটনার পর গত কয়েকদিন ধরেই মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের আত্মগোপনে থাকা একজন নেতা প্রশ্ন রাখেন, পরিস্থিতি যেহেতু স্বাভাবিক হয়ে গেছে তাহলে কারফিউ কেন, কীসের ভয় তাদের? মূল বিষয়টা হলো, কারফিউ তুললেই নিহতের প্রকৃত সংখ্যা প্রকাশ পেতে থাকবে, তখন বিক্ষুব্ধ জনতাকে সামলানো এবার আর সম্ভব হবে না।

শনিবার কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল থাকলেও শহরের কাঁচাবাজার, লঞ্চঘাট, বিসিক এলাকাসহ বেশির এলাকা ছিল জনমানবশূন্য। রিকশা ও অটো রিকশা চলাচল ছিল সীমিত।

কারাফটকে ভিড়

শনিবার আটকদের অনেকের স্বজনেরা ভিড় করেন কারাগার ও সদর থানার ফটকে। তাদের অনেকে বন্দি স্বজনের জন্য টাকা ও কাপড় জমা দিচ্ছিলেন। তবে অনেকে তাদের স্বজনদের খোঁজ পাননি কারণ তাদের পাশের কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে স্থান সংকুলান না হওয়ায়।

আটকদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগকে বিনা কারণে আটক করা হয়েছে, ঘটনার দিন তারা কাজে ছিলেন, রাতে বাসায় ফেরার পর তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মোজাম্মেল শেখ নামে একজন সমকালকে বলেন, “আমার ভাইগনে আসিফ মোল্লার বয়স ১৬ বছর হইছে। সে বিসিক এলাকার ভাই-ভাই বেকারিতে কাজ করে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে কারখানা থেকে বারইয়া (বের হয়ে) পাশের খালে গোসল করতে যায়। সেখানে তারেসহ পাঁচজনরে ধরে পুলিশ।”

বুধবার হামলা-সংঘর্ষের সময় সে কারখানাতেই ছিল বলে জানান মোজাম্মেল।

একই বয়সের আরেক কিশোর প্রিন্স অধিকারীকে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে কোটালীপাড়ার আমতলী মনসাবাড়ী এলাকার বাসার সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তার বাবা প্রদীপ অধিকারী ও মা লিপিকা অধিকারী জানান, এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এক বিষয়ে ফেল করে প্রিন্স। এ কারণে বাসায় থেকে সামনের বছর ভালো ফল করার জন্য পড়ালেখা করছিল। বুধবার সে বাসাতেই ছিল। তাকে কেন ধরা হয়েছে, বুঝতে পারছেন না এই দম্পতি।

আমতলী মনসাবাড়ী এলাকার তরুণ রিফাত বিশ্বাস (২০) প্রসাধনসামগ্রীর দোকানে কাজ করেন।

রিফাতের মামি শাকিলা আক্তার তুলি বলেন, “আমাগে কাছেই বড় হইছে রিফাত। আমাগে বাসায় থাকে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার সময় আমতলী থেকে তারে ধরে আনে পুলিশ।”

বুধবার শহরে সংঘর্ষের সময় তিনি দোকানেই ছিলেন বলে জানান স্বজনরা।

এরকম অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে, যারা নিরপরাধ মানুষজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রবাস ফেরত এক যুবক বলেন, “শুনেছি একাত্তরে যুদ্ধের সময় যুবকদের ধরে নিয়ে যেত হানাদার বাহিনী। গোপালগঞ্জে যা চলছে তা একাত্তরকে হার মানিয়েছে। এখানে তো বাচ্চাদেরও আটক করা হয়েছে। পেলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে।”

এইচআরএফবির বিবৃতি

এদিকে রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘর্ষ, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ঘটনায় পাঁচজন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ (এইচআরএফবি)।

এ ধরনের ঘটনা নাগরিক নিরাপত্তা, সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত বলে মনে করছে এই মানবাধিকার সংগঠন।

বিবৃতিতে শিক্ষক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মীসহ ২৩ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষর রয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

আরও পড়ুন