আওয়ামী লীগের শাসনামলে ঢাকায় প্রায় অলস বসে থাকা পাকিস্তানের হাই কমিশনার সৈয়দ মারুফ আহমেদের তৎপরতা হঠাৎ বেড়ে যায় জুলাই অভ্যুত্থানের পর। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন ফোরামেও হাজির হচ্ছিলেন তিনি; বলছিলেন অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বিনির্মাণের কথা।
সেই মারুফ আহমেদের হঠাৎ ছুটি নিয়ে ঢাকা ত্যাগ সবার মধ্যে কৌতূহল তৈরি করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে তার ছুটি নেওয়ার খবর এসেছে। তবে কেন এই ছুটি, তার কারণ আসেনি। ঢাকায় পাকিস্তান হাই কমিশনও এনিয়ে কিছু জানায়নি। এখন ভারতের সংবাদপত্রে খবর এল, হানি ট্র্যাপের শিকার হয়েছেন এই কূটনীতিক।
মারুফ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় পাকিস্তানের হাই কমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে আসেন। তখন ক্ষমতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক তখন তলানিতে।
ফলে ঢাকায় এলেও খুব একটা কাজ ছিল না মারুফের। কিন্তু আট মাস পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মারুফের দৌড়-ঝাঁপ বেড়ে যায়। নিয়মিত সচিবালয়ে দেখা যাচ্ছিল তাকে, দেখা করছিলেন বিভিন্ন উপদেষ্টার সঙ্গে। বিশেষ করে অভ্যুত্থানের নেতাদের মধ্যে যারা উপদেষ্টা হন, তাদের সঙ্গে।

মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারও এই সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বিনির্মাণে উদ্যোগী হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে দুই দফায় বৈঠক করেন ইউনূস। সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়, পাকিস্তানের পণ্য বন্দর েথকে ছাড় করাও সহজ করে দেওয়া হয়।
মারুফের তৎপরতায় এক যুগ পর পাকিস্তানের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের দিন-ক্ষণও চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু কাশ্মীর সীমান্তে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার পর সেই সফর স্থগিত হয়ে যায়। তার মধ্যেই গত ১১ মে মারুফ ছুটি নিয়ে ঢাকা ছাড়েন বলে খবর আসে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।
প্রখম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ মে সকালে দুবাই হয়ে ইসলামাবাদ যেতে ঢাকা ছাড়েন মারুফ। সেদিনই পাকিস্তান হাই কমিশন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তার অনুপস্থিতির বিষয়টি জানায়।
প্রথা অনুযায়ী, একজন রাষ্ট্রদূত কোনো দেশে দায়িত্ব পালনের সময় ছুটিতে গেলে স্বাগতিক দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়।
তবে মারুফ কতদিন ছুটিতে থাকবেন, সেই বিষয়ে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান। পরে পাকিস্তান হাই কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, দুই সপ্তাহের ছুটিতে গেছেন মারুফ।
তার ছুটিতে যাওয়া নিয়ে নানা জল্পনার মধ্যে গত ৯ মে কক্সবাজার সফরে প্রসঙ্গটি আসে। আর সেখানেই মারুফ ফাঁদে পড়েছিলেন বলে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
তাতে বলা হচ্ছে, কক্সবাজারে ব্যক্তিগত সফরে গিয়েছিলেন মারুফ, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের সরকারি এক নারী কর্মকর্তাকে। সেই খবর জানাজানি হওয়ার কারণেই মারুফকে ছুটিতে পাঠানো হয়।
ঢাকায় সম্প্রতি সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসুফ ঈসা আলদুহাইলানের সঙ্গে মডেল মেঘনা আলমের সম্পর্ক ঘিরে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছিল। মেঘনাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করা হলে তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনাও ওঠে।

মেঘনাকে আদালতে হাজিরের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী দাবি করেছিলেন, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিককে হানি ট্র্যাপে ফেলার চক্রান্তে রয়েছে একটি চক্র।
সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা চলে যাওয়ার পর মারুফেরও ঢাকা ছাড়ার ঘটনায় সেই বিষয়টিই আবার সামনে এল। তবে মারুফের ক্ষেত্রে যে নারীর কথা আসছে, তার বিষয়ে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শোনা যায়নি।
ভারতের নর্থ ইস্ট নিউজের সাংবাদিক চন্দন নন্দী জানাচ্ছেন, মারুফের খবরটি জানাজানি হওয়ার পর ইউনূস সরকারই তাকে ঢাকা ছাড়া করতে চাপ দিচ্ছিলেন ইসলামাবাদকে।
যে নারীর কথা বলা হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ২৩ বছর বয়সী এক কর্মকর্তা বলে নর্থ ইস্ট নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়।
কূটনীতিকদের ফাঁসাতে নারীদের ব্যবহার বিশ্বের ইতিহাসে বহু পুরনো এক কৌশল; যা এখনও যে কার্যকর, তার মারুফের ঘটনায় আবার প্রমাণিত হলো।
তবে পাকিস্তানি হাই কমিশনারকে হানি ট্র্যাপে কে, কেন ফেলল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য এখনও মিলছে না।