যে কোনো দুটি দেশের সম্পর্কের গতিপথ ঠিক করে দেয় রাজনীতি। সেই রাজনীতির দৃশ্যপট বদলানোর পথ ধরে অর্থনৈতিক সম্পর্কও গাঢ় হচ্ছে; সাংস্কৃতিক অঙ্গনই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? তাই হয়ত এবার পাকিস্তানি এক মডেল আসছেন ঢালিউডের নায়িকা হয়ে।
জারা আহমেদ নামে পাকিস্তানি মডেলের ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিষেকের খবরে এখন সোশাল মিডিয়ায় চলছে তুমুল আলোচনা। গত মঙ্গলবারই তিনি ‘ফোর্স’ নামে একটি সিনেমার নায়িকা হতে চুক্তিবদ্ধ হন। তারপরই প্রশ্ন ওঠে- হঠাৎ পাকিস্তানি নায়িকা কেন?
পাকিস্তানি কোনো অভিনেত্রী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কখনো অভিনয় করেননি, ব্যাপারটি তেমন নয় অবশ্য। তবে কবে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে যে হবে আজ থেকে ৩৯ বছর আগে। পাকিস্তানের নামি এক অভিনেত্রী বাবরা শরিফ তখন বাংলাদেশের একটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন।
তারপর আরও কোনো পাকিস্তানি অভিনেত্রীর বাংলাদেশের সিনেমায় যুক্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায় না। তবে এই সময়ে অনেক ভারতীয় অভিনয়শিল্পী কাজ করে গেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রে।
কিন্তু গত বছর ছাত্র-জনতা্র অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক টানাপড়েন চলছে। তাতে ভারতীয় শিল্পীদের বাংলাদেশে আসা রয়েছে বন্ধ।
এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্পর্ক উষ্ণতার দিকে গড়াচ্ছে। স্বাধীনতার পর গত বছরই প্রথম পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। পাকিস্তানি হাই কমিশনারের দৌড়ঝাঁপও অনেক বেড়েছে।
ভারতীয় কোনো শিল্পীর না আসার মধ্যে পাকিস্তানি সঙ্গীতশিল্পী রাহাত ফতেহ আলী খান অনুষ্ঠান করে গেছেন ঢাকায়। কনসার্ট করে গেছে জাল, কাভিশের মতো ব্যান্ডগুলোও। বাংলাদেশে পাকিস্তানি টিভি সিরিয়ালের দর্শক বেড়েছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এসবের মধ্যেই এবার পাকিস্তানি মডেল ও অভিনেত্রী জারা খানকে নিয়ে সিনেমা বানাতে নেমেছেন বাংলাদেশি নির্মাতা আসিফ ইকবাল জুয়েল। তার ফোর্স সিনেমায় জারার চুক্তি সইয়ের খবর বুধবার জানাজানি হয়।
কেন জারাকে বেছে নিলেন- সেই প্রশ্নের উত্তরে আসিফ প্রথম আলোকে বলেন, তার সিনেমায় পুলিশ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জারার মতোই একজন অভিনেত্রীকে খুঁজছিলেন তিনি।
“আমাদের চাওয়া ছিল, নিয়মিত জিম করেন, এমন একজন অভিনয়শিল্পী, যিনি মারপিট করতে পারবেন, যাকে দেখতে পরিশ্রমী মনে হবে, মুখটা হতে হবে লম্বাটে, চোয়াল কিছুটা ভাঙা। মোটকথা, যে মেয়েটাকে অ্যাকশনে মানায়। অনেক খোঁজার পর আমরা পাকিস্তানের মডেলকে পছন্দ করেছি।”
জারার খোঁজ কীভাবে পেলেন- সেই প্রশ্নে এই নির্মাতা বলেন, সিরিয়ালে জারার অভিনয় দেখে পছন্দ হয় তার। পরে তিনি ‘ফোর্স’ সিনেমার ৩০ সেকেন্ডের একটি লুক এই মডেলের সঙ্গে শেয়ার করেন।
“আমাদের অ্যাকশন লুক দেখেই পাকিস্তানের মডেল অবাক হয়ে যান। পরে তাকে সিনেমার চিত্রনাট্যসহ পুরো পরিকল্পনা পাঠাই। তিনি দেখে পছন্দ করেছেন। ব্যাটে–বলে মিলে যাওয়ায় আমরা কাজটি করছি।”
মডেরিং দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা জারা পাকিস্তানেও ‘ছু লে আসমান’ নামে একটি সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন। তার আগে ‘হাম কাহা কে সোচে থে’, ‘খুদসার’সহ একাধিক টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেন তিনি।
বর্তমানে ফোর্স সিনেমার প্রি–প্রোডাকশনের কাজ চলছে। আগামী ১০ এপ্রিল এফডিসিতে শুটিং শুরুর পরিকল্পনা নির্বাতার। কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরেও শুটিং হবে। জারা বাংলাদেশে এসে টানা দুই সপ্তাহ শুটিং করবেন বলে জানান আসিফ।
জারা আসার চার দশক আগে ঢাকায় এসে অভিনয় করে গিয়েছিলেন বাবরা শরিফ। ‘লেডি স্মাগলার’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত সেই সিনেমাটির প্রযোজক ছিলেন চিত্রনায়িকা ববিতা।

১৯৮৬ সালে মুক্তি পাওয়া লেডি স্মাগলারে ববিতা নিজেও অভিনয় করেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন সোহেল চৌধুরী (প্রয়াত)। জারার মতো বাবরা শরিফও সেই সিনেমায় ছিলেন অ্যাকশনধর্মী চরিত্রে।
এখন ৭০ বছর বয়সী বাবরা শরিফ ছিলেন গত শতকের ৮০ এর দশকে পাকিস্তানের জনপ্রিয় দুই অভিনেত্রীর একজন। আরেকজন কে ছিলেন, জানেন? তিনি হলেন শবনম।
পূর্ব বাংলার েময়ে ঝর্ণা বসাক চলচ্চিত্রে নেমে শবনম নাম নেন। নামটি দিয়েছিলেন খ্যাতনামা চলচ্চিত্র নির্মাতা এতহেশাম। বাংলা সিনেমা দিয়ে শুরুর পর পাকিস্তান আমলে উর্দু সিনেমা চান্দায় অভিনয় করে রাতারাতি তারকাখ্যাতি অর্জন করেন শবনম। সেই খ্যাতির মায়ায় পাকিস্তানেই থেকে যান তিনি, হয়ে ওঠেন দেশটির শীর্ষ নায়িকা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও শবনম পাকিস্তানেই অভিনয় করে যাচ্ছিলেন। পাকিস্তানের সম্মানসূচব নিগার পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার সবই পান তিনি।
১৯৮৮ সালের দিকে শবনম বাংলাদেশে চলে এলে ললিউড বা পাকিস্তানের চলচ্চিত্রাঙ্গনে বাবরা শরিফের একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়। তখনকার দুই নায়ক নাদিম ও ফয়সালের সঙ্গে চুটিয়ে অভিনয় করে যান তিনি।
এই নাদিম ও ফয়সাল দুজনেই ঢাকার চলচ্চিত্রে অভিনয় করে গেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে য়ৌথ চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি চল তৈরি হয়। সেই ধরনের চলচ্চিত্রে এই দুই নায়ককে দেখা গেছে।
১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত দূরদেশ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন নাদিম। ‘দুশমনি করো না প্রিয়তম’- এই গানের চিত্রায়নে ববিতার সঙ্গে তার রসায়ন তখনকার অনেকের মনে এখনও ভাসে।
আবার ‘মিস লংকা’ সিনেমায় ‘চুরি করেছ আমার মনটা, হায় রে হায় মিস লংকা’ এই গানে ফয়সালের নাচও তখনকার কারও ভোলার নয়; এখানেও নায়িকা সেই ববিতা।
নাদিম শাবানার সঙ্গে বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন। বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় অভিনেত্রীর প্রথম সিনেমা চকোরীর নায়কও ছিলেন নাদিম।
গত শতকের ৯০ এর দশকের শুরুতে নাদিম-শাবানার ‘ঝড় তুফান’র পর পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার আর কোনো সিনেসার খবর পাওয়া যায় না। তবে ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ থেমে ছিল না।
এর মধ্যে ২০১১ সালে মুক্তি পাওয়া রুবাইয়াৎ হোসেন নির্মিত বহুল আলোচিত-সমালোচিত ‘মেহেরজান’ সিনেমায় ওমর রহিম নামে একজন পাকিস্তানি অভিনেতা অভিনয় করেন। তার ১৪ বছর পর এখন জারা আসছেন ঢালিউডে।