শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির (সিজেসিএসসি) চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের ছবিতে দেখা গেছে, পাকিস্তানের ওই সেনা কর্মকর্তা হাতে একটি ব্যাটন বা লাঠি বহন করছেন, যা সাধারণত সেনাবাহিনীর নিজস্ব আনুষ্ঠানিক প্রথার অংশ। এই লাঠিকে সোয়াগার স্টিক বলা হয়।
তবে আরেক দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এই সোয়াগার স্টিক বহন করা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।
ইতিহাস ও তাৎপর্য
ঐতিহাসিকভাবে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ড্রিল ও অন্যান্য সামরিক আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে এই ব্যাটন ব্যবহার শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল দূরত্ব মাপা, নির্দেশ প্রদান ও যোগাযোগের সুবিধা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সোয়াগার স্টিক এর গুরুত্ব বেড়েছে। বর্তমানে এটি সামরিক ঐতিহ্য ও আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে কর্মকর্তার কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও কমান্ডের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি কর্মকর্তার পদমর্যাদা ও অধীনস্থ সৈন্যদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।
সামরিক আনুষ্ঠানিকতা যেমন কুচকাওয়াজ, পরিদর্শন ও দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠানের একটি অপরিহার্য অংশ সোয়াগার স্টিক। ড্রিল ও ব্রিফিংয়ের সময় এটি নির্দেশনা দেওয়া, ভুল সংশোধন করা ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জোর দিয়ে বোঝানোর কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সোয়াগার স্টিক বহন করা আত্মবিশ্বাস ও স্থিরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়, যা কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বের উপস্থিতি প্রকাশ করে।
অর্থাৎ সোয়াগার স্টিকের ব্যবহার মূলত সামরিক পরিবেশে প্রযোজ্য এবং এটি একটি ঐতিহ্যের বিষয় হিসেবেও বিবেচিত।
বাংলাদেশের আইনে কী বলে
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে কোনো ব্যক্তি ব্যাটন বা তদ্রূপ কোনো বস্তু বহন করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (বা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়) এবং বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (এসএসএফ) অত্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা নীতি অনুসরণ করে।
মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। ব্যাটন, লাঠি, ধাতব প্রান্তযুক্ত ছাতা বা কলমের মতো অস্ত্রসদৃশ বস্তু বহন নিষিদ্ধ।

অস্ত্র আইন বা জননিরাপত্তা নীতিমালার অধীনে ব্যাটনকে প্রতিরক্ষামূলক বা আক্রমণাত্মক সরঞ্জাম হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। কেউ এটি আনুষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য বহন করলেও, এটি কোনো উচ্চ নিরাপত্তা এলাকায়, বিশেষ করে যেখানে সরকারপ্রধান উপস্থিত থাকেন, সেখানে বহন অনুমোদিত নয়।
শুধুমাত্র অনুমোদিত নিরাপত্তাকর্মীরা (এসএসএফ, পুলিশ বা প্রোটোকল কর্মকর্তারা) সরকারি দায়িত্ব পালনকালে এমন বস্তু বহন করতে পারেন। বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই বিধি প্রযোজ্য নয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশের অধীনে, নির্দিষ্ট স্থানে অস্ত্র, তলোয়ার, তীর, আগ্নেয়াস্ত্র, ছুরি, লাঠি বা লাঠির মতো যেকোনো বস্তু যা শারীরিক সহিংসতা সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হতে পারে, বহন নিষিদ্ধ। এটি প্রমাণ করে যে “লাঠি” বা ব্যাটন সংবেদনশীল অঞ্চল বা জননিরাপত্তা সংক্রান্ত স্থানে আইনত নিষিদ্ধ।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও সিজেসিএসসি চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার ছবি দুই দেশের দুটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিধিত্ব করছে। একজন বেসামরিক সরকারপ্রধানের সঙ্গে আরেক দেশের সামরিক কর্মকর্তার এমন সামরিক ভঙ্গিমার চিত্র রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন বার্তা দেয়।
আনুষ্ঠানিক বৈঠকে এমন সামরিক আনুষ্ঠানিকতা শিষ্টাচার বহির্ভূত কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এই ধরনের চিত্র সাধারণত জনমনে সমন্বয় ও আত্মবিশ্বাসের বার্তা দেয়। এটি দেখায় যে উভয় পক্ষ একই লক্ষ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করতে সম্মত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পরামর্শমূলক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বজায় আছে।

এছাড়াও গ্রুপ ছবিতে মানা হয়নি প্রটোকল। নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান সমসংখ্যক প্রতিনিধি দু’পাশে রেখে নিজে মধ্যবর্তী অবস্থানে দাড়িয়ে ছবি তুলবেন।
গ্রুপ ছবিতে দেখা যায় প্রধান উপদেষ্টার ডান পাশে আছেন চারজন আর বাম পাশে ছয় জন।
মুহাম্মদ ইউনূসের বামে খলিলুর রহমান ও সেনা সদর দপ্তরের দুই মেজর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ডানে জেনারেল মির্জা, ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার, পাকিস্তান নৌবাহিনীর কমোডর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ একজন দূতাবাস কর্মকর্তা।
পাকিস্তানের জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার হাতে সোয়াগার স্টিক থাকলেও, বাংলাদেশের কোন সেনা কর্মকর্তার হাতে সেরকম কিছু ছিল না। ফলে সামরিক দৃশ্যপটে কার্যত শামশাদ মির্জাকেই সর্বোচ্চ র্যাংকের কোন কর্মকর্তা মনে হয়েছে; আর বাকিরা তার অধীনস্ত।



