আমাজন জঙ্গলের ব্রাজিল অংশে স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা দিয়ে তোলা নতুন ছবিতে ধরা পড়েছে আধুনিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনগোষ্ঠীকে, যেসব ছবি বিশ্লেষণে ধারণা করা হচ্ছে চোরাচালানিদের ব্যাপক দৌরাত্ম্য এবং দখলদারদের চাপ সত্ত্বেও তাদের সংখ্যায় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
ওই এলাকা দিয়ে প্রবাহিত নদীর নামে, অর্থ্যাৎ ‘মাসাকো’ নামে তাদের অভিহিত করা হলেও তারা নিজেদের মধ্যে কি নামে পরিচিত তা এখনও অজানা। কারণ তাদের ভাষা, বিশ্বাস কিংবা সামাজিকতা সম্পূর্ণ রহস্যের জালে মোড়ানো।
ছবিগুলো তুলেছে ব্রাজিলের সরকারি সংস্থা ব্রাজিলিয়ান ন্যাশনাল ইনডিজেনাস পিপলস ফাউন্ডেশন (ফিউনাই)। এই জঙ্গলের সুরক্ষার জন্য দশকের পর দশক ধরে কাজ করছে তারা।
ফিউনাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, নব্বইয়ের দশকের পর থেকে মাসাকোদের সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ বেড়ে ২০০ থেকে ২৫০–এ উন্নীত হয়েছে।
ফিউনাই আমাজনের যেসব স্থানে ক্যামেরা লাগিয়েছিল, সেখানে উপহার হিসেবে ধাতব উপকরণ বা টুলস ফেলে রাখা হতো যাতে করে মাসাকোরা যেন এই যন্ত্রগুলোর খোঁজে চাষাবাদের খামার বা কাঠ কাটার স্থানে হানা না দেয়।
এর আগেও মাসাকোদের বসতির ছবি তুলেছিল ফিউনাই। পরে স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে দেখা যায়, ওই বসতিগুলো ছেড়ে তারা চলে গেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে চালানো এই পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে, মৌসুমভেদে মাসাকোরা আমাজনের ভেতরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় তাদের বসতি সরিয়ে নেয়। তীর-ধনুক দিয়ে শিকার করে পশুপাখি। আর বহিরাগতরা যেন তাদের এলাকায় প্রবেশ না করতে পারে, সে জন্য মাটিতে পুঁতে রাখে হাজার হাজার ধারালো গজাল।
ফিউনাইয়ের হয়ে কাজ করেন সরকারি কর্মকর্তা অল্টায়ার আলগেয়ার। মাসাকোদের ভূখণ্ড রক্ষার জন্য তিন দশকের বেশি সময় ধরে লেগে আছেন তিনি।
আলগেয়ার বলেন, এই ছবিগুলো থেকে জানা যাবে, বলিভিয়ার গুয়াপর নদীর অপর পাশে বসবাস করা ‘সিরিয়ন’ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মাসাকোদের মিল আছে কি না। তবে মাসাকোদের পরিচয় এখনো জানা সম্ভব হয়নি।
২০২৩ সালে বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নেচারের তথ্য অনুযায়ী, পেরু ও ভেনেজুয়েলা সংলগ্ন ব্রাজিল সীমান্তে মাসাকোদের মতো আদিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে। স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে সেখানে বড় এলাকাজুড়ে চাষাবাদের জমি এবং আদিবাসী বসতিও দেখা গেছে।
অন্যদিকে আমাজনের গহিনে যেসব আদিবাসী চাষাবাদ ও বসতি স্থাপন করে না, যাযাবর হিসেবে থাকে, তাদের জনসংখ্যাও বাড়ার ইঙ্গিত পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এমনই এক আদিবাসী জনগোষ্ঠী পাদ্রো নদী অঞ্চলের ‘খাওয়াহিভা’। ব্রাজিলের মাতো গ্রোসে রাজ্যের আমাজন জঙ্গলে তাদের দেখেছেন ফিউনাইয়ের কর্মকর্তা জইর কনডোর।
তিনি বলেন, “আমাদের ধারণা, বর্তমানে এই জনগোষ্ঠীতে ৩৫ থেকে ৪০ জন রয়েছে। ১৯৯৯ সালে যখন আমরা কাজ শুরু করেছিলাম, তখন তা ২০ জনের মতো ছিল।”
ব্রাজিল, বলিভিয়া, কলম্বিয়াসহ ৯টি দেশের ২১টি আদিবাসী ও নাগরিক সংগঠনের জোট ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং গ্রুপ অব ইনডিজেনাস পিপলস ইন আইসোলেশন অ্যান্ড ইনিশিয়াল কন্ট্রাক্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকার আমাজন ও গ্রান চাকো অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক হিসাবে ৬১টি আদিবাসী গোষ্ঠী রয়েছে। এর বাইরে আরও ১২৮টি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যাদের এখনো সরকারিভাবে যাচাই করা হয়নি।
বিচ্ছিন্ন এই আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোকে রক্ষার জন্য ব্রাজিল সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট আইন না থাকলেও পেরু ও কলম্বিয়া বেশ জোড়ালো ভূমিকা রাখছে বলে নেচারের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
আমাজন জঙ্গল নিয়ে কাজ করা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইন দ্য আমাজনের সহপ্রতিষ্ঠাতা পাওলো মৌতিনহো বলেন, “এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার অধিকার আছে। নিজেদের ভূখণ্ডে থাকার অধিকার আছে। নিজেদের পছন্দমতো জীবন যাপন করার অধিকার আছে। এ ছাড়া আমাজন জঙ্গল রক্ষার জন্যও বিচ্ছিন্ন এই আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সম্মান জানানোটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।”
বিপ্লব পাল, দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে