বিদেশ থেকে এসে সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১১ মাসে ১১ বার বিদেশ সফর করলেন মুহাম্মদ ইউনূস। সর্বশেষ সফরটি দ্বিপক্ষীয় রূপ দেওয়ার চেষ্টা হলেও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সাক্ষাৎ না দেওয়ায় লন্ডন থেকে অন্তত এক্ষেত্রে বিফল হয়েই ফিরতে হয়েছে তাকে।
আর এই ঘটনা তার মাসে মাসে বিদেশ সফর যেমন সামনে এনেছে; তেমনি জনগণের অর্থ ব্যয় করে তার এই সফরের যৌক্তিকতাও প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বিশাল বহর নিয়ে তার বিদেশ সফর ছিল বেশ সমালোচিত। অভ্যুত্থানে তার পতনের পর পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা বিপরীতই ঘটনাই দেখতে হচ্ছে জনগণকে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বিদেশ সফর নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। তাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন-কার্টুনও হয়েছিল। এখন ইউনূস তাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছেন বলে কারও কারও মনে হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট যখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, নোবেলজয়ী ইউনূস তখন ছিলেন প্যারিসে। তিন দিন পর দেশে ফিরেই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন।
ওই মাসে তিনি কোনো বিদেশ সফর করেননি। তার বিদেশ সফর শুরু হয় পরের মাস সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্য দিয়ে।
এরপর ওই বছরের নভেম্বরে আজারবাইজানে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৯) যোগ দিতে যান তিনি। এরপর ডিসেম্বরে মিশর যান ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে।
এই বছর অর্থাৎ ২০২৫ সাল তার শুরু হয় সুইজারল্যান্ড সফর দিয়ে। জানুয়ারিতে তিনি ওই সফর করেন ডাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (উব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে।
এরপর এই বছর চীন, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ সফরের পর গত ৯ জুন যুক্তরাজ্য সফরে যান ইউনূস। বলা হয়েছিল, এই সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি, পুরস্কার নেবেন রাজা চার্লসের হাত থেকে, দেখা হবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে।
কিন্তু রাজা ও তারেকের দেখা পেলেন স্টারমার সময় দেননি ইউনূসকে। তারমধ্যে তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ‘স্টারমার’ বিদেশে রয়েছেন বলে ভুল তথ্য দিয়ে তা মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ এবিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেন, এ সফরে সরকারের অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যা পুরো সফরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
“সরকারের দিক থেকে যা যা বলা হয়েছে এ সফর নিয়ে, তাতে স্বচ্ছতার প্রচণ্ড অভাব আছে। একটি দলের নেতার সাথে বৈঠক হয়ত রাজনীতিতে স্বস্তি এনেছে। কিন্তু সেজন্য প্রধান উপদেষ্টাকে এত বড় দল নিয়ে সেখানে যেতে হবে, এটা কেমন কথা।”
ইউনূসের আগের বিভিন্ন সফর নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা এর আগেও যেসব বিদেশ সফরে গেছেন, তার মধ্যে কতগুলো সত্যিকার অর্থে দ্বিপাক্ষিক সফর ছিল, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এগুলো তার এতদিনকার ভাবমূর্তির সঙ্গে মানানসই হয়নি।”
এই সফরে ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীসহ প্রায় ৪০ জনের দলের লন্ডনের বিলাসবহুল হোটেলে থাকার খরচ নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন শায়ের লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে ইউনূস ও তার সফরসঙ্গীদের থাকায় রাষ্ট্রের সাড়ে ৩ কোটি টাকা খরচের প্রামাণ্য একটি হিসাবও দেন।
তিনি ফেইসবুকে লেখেন, “প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড.ইউনূস ও তার সফর দল গত ৯ জুন ২০২৫ যুক্তরাজ্য সফরে আসেন। তাদের অবস্থানের জন্যে লন্ডন শহরের অন্যতম ব্যয়বহুল দ্যা হোটেল ডরচেস্টারে ৪ রাতের জন্যে যে ৩৭টি রুম রিজার্ভ করা হয়। তাদের হোটেল বিলের একটি কপি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৩৯ জনের সফরদল ৪ রাত অবস্থানের জন্যে ব্যয় করেছে ২১০,৩২৫ ব্রিটিশ পাউন্ড বা প্রায় ৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা ( ১ পাউন্ডঃ ১৬৬ টাকা হিসেবে)।
“সর্বোচ্চ ব্যয়বহুল কক্ষ যেখানে অবস্থান করেন প্রধান উপদেষ্টা, সেটি দৈনিক ৬০৪৫ পাউন্ড বা ১০ লক্ষ টাকায় ভাড়া করা হয়। কেবল তার কক্ষেরই বিল আসে ৪০ লক্ষ টাকা বা ২৪,১৮০ পাউন্ড।।”
লন্ডনে বাংলাদেশ বিমানের সরাসরি ফ্লাইট থাকা সত্ত্বেও ইউনূসের এমিরেইটসের ফ্লাইট ব্যবহারে ভ্রমণ খরচ বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেন শায়ের।
তিনি েলখেন, “দেশের সরকার প্রধান অবশ্যই বিদেশ সফরে যেতে পারেন, তার নিরাপত্তা ও মর্যাদা বিবেচনায় যে কোন শীর্ষ হোটেলেই তিনি ও তার দল অবস্থান করতে পারেন। কিন্তু তার এই সফরে বাংলাদেশ কী পেল বা কীভাবে লাভবান হল, সেটা প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ।
“তিনি এখানে দ্বিপাক্ষিক কোনও বৈঠকের জন্য আসেননি, সেটা তো নিশ্চিত। ব্রিটিশ রাজার কাছ থেকে ব্যক্তিগত পুরস্কার গ্রহণ করেছেন কেবল। আর আজ বিএনপির শীর্ষ নেতা জনাব তারেক রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে বলেও জানা যায়নি।”
বাংলাদেশের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি প্রধান উপদেষ্টার এই সফরকে ‘দরিদ্রের টাকায় বিলাসবহুল বিশ্বভ্রমণ’ আখ্যায়িত করেছেন।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনিস আলমগীর বলেছেন, ইউনূস এখন পর্যন্ত যত সব ভ্রমণে যাচ্ছেন, সবগুলোতে রাষ্ট্রের টাকায়ই যাচ্ছেন এবং তিনি “ভ্রমণবিলাসে” আছেন।
“ব্রিটিশ চ্যারিটি পুরস্কার আনতে এত বড় বহর নিয়ে তার যাওয়ার কেন প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল, আমরা জানি না। গত ১০ মাসে ড. ইউনূস এই সফরসহ ১১-১২টি বিদেশ সফরে গেছেন, যার সবগুলো সরকারি অর্থে। এর মধ্যে একমাত্র চীন সফর ছিল দ্বিপাক্ষিক।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের খরচসহ সামগ্রিক বিষয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।
লন্ডন সফরে খরচ নিয়ে সরকারের কোনো ভাষ্য এখনও পাওয়া যায়নি। তবে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সোমবার আরেকজনের একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন, সেখানে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর লন্ডন ও জেনেভা সফরের বর্ণনা দিয়ে ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরকে যৌক্তিক করার প্রয়াস চালানো হয়।
স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে ১৯৭২ সালের ২১ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জেনেভা সফরের প্রসঙ্গ ধরে সেই পোস্টে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ছিলেন ১৯ জন, তার মধ্যে পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। প্রাথমিকভাবে ১০ দিন থাকার পরিকল্পনা থাকলেও সফরটি গড়ায় ২৩ দিনে।
ওই সফরে বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে জেনেভার বেলভিউতে অবস্থিত ‘লা রিজার্ভ’ হোটেলে ছিলেন জানিয়ে সেই পোস্টে দাবি করা হয়, তিন সপ্তাহের এই সফরের মোট খরচ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে। হোটেল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮০ সুইস ফ্রাঁ বিল করেছিল, কিন্তু পরে কিছু ছাড় দিয়ে খরচ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৪৭ ফ্রাঁ। সেই সঙ্গে ভ্রমণ খরচ মিলিয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯২৫ সুইস ফ্রাঁ। এই অঙ্ক এখনকার হিসাবে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার সমান।
তবে ওই সফরের ব্যয় সুইজারল্যান্ড সরকারই দিয়েছিল জানিয়ে আসিফ নজরুলের শেয়ার করা ওই পোস্টে বলা হয়, “সুইস ফেডারেল কাউন্সিল এবং প্রটোকল বিভাগ উচ্চ খরচের বিষয়টি স্বীকার করলেও তারা বারবার এটিকে ‘স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য একটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সফর’ এবং ‘ভারতীয় উপমহাদেশে রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে সুইজারল্যান্ডের বিশেষ ভূমিকা’ উল্লেখ করে এর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। তারা আরও যুক্তি দেয় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল সফরসঙ্গী প্রয়োজন ছিল, কারণ তাকে একটি ‘অত্যন্ত কঠিন সময়ে’ দেশ পরিচালনা করতে হচ্ছিল।”
সেবার লন্ডন থেকে জেনেভা গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু লন্ডনে কী হয়েছিল, সেই কথাটি এই পোস্টে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়।
সেই সফর শেষে দেশে ফেরার দিন দৈনিক বাংলায় যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল, তা থেকে জানা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু ২৭ জুলাই লন্ডন গিয়েছিলেন তার পিত্তথলির পাথর অপসারণে অস্ত্রোপচার করাতে। সেই কারণে তার পরিবারের সদস্যরাও সফরসঙ্গী হয়েছিলেন।
৩০ জুলাই লন্ডনের হাসপাতালে বঙ্গবন্ধুর অস্ত্রোপচার হয়েছিল। পাশাপাশি তখন তার অ্যাপেডিক্সও অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা কিছু দিন বঙ্গবন্ধুকে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। তখন চিকিৎসকদের পরামর্শ ও সুইজারল্যান্ডের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তিনি ২০ আগস্ট জেনেভায় যান। ৫ সেপ্টেম্বর তার দেশে ফেরার দিনক্ষও ঠিক হয়েছিল।
কিন্তু জেনেভায় গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেন চিকিৎসকরা। তখন সঙ্গে থাকা ব্যক্তিগত চিকিৎসক জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের পরামর্শে আরও কিছু দিন জেনেভায় থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ড থেকে ভারত হয়ে দেশের পথে রওনা হন বঙ্গবন্ধু।
ঠিক ওই সময়েই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের সদস্যপদের আবেদন নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। দিল্লিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর উদ্দেশে বলেছিলেন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরই কেবল বন্দি মুক্তিসহ অন্য সব আলোচনা হতে পারে।