মিয়ানমারে যুদ্ধযুদ্ধের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ দিয়ে একটি করিডোর স্থাপন নিয়ে আলোচনার ঝড় চলছে অনলাইনে-অফলাইনে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরের সফর এই করিডোর স্থাপনের প্রস্তাব দিয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর এনিয়ে তেমন আলোচনা না উঠলেও সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এই করিডোর স্থাপনে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানানোর পরই শুরু হয় তুমুল আলোচনা।
বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্তে নেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন আসে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে ভিন দেশের যুদ্ধে বাংলাদেশকে জড়ানোর ঝুঁকি কেন নিচ্ছেন, সেই প্রশ্নও উঠছে।
এমন প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান যে এবিষয়ে সিদ্ধান্ত তো দূরে থাক, কারও সঙ্গে আলোচনাও হয়নি।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, এমন করিডোর স্থাপন করতে হলে সংিশ্লষ্ট দুই দেশেরই সম্মতি প্রয়োজন।
মিয়ানমার সরকার এই বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে, এমন খবর এখনও কোথাও পাওয়া যায়নি।
তারপরও বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে করিডোর স্থাপন নিয়ে আলোচনা থেমে নেই।
সেই সঙ্গে রাখাইন রাজ্য ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ের পটভূমিও আসছে আলোচনায়; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত এমনকি রাশিয়ার স্বার্থও রয়েছে।
মিয়ানমারের সঙ্কটের কারণে ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীর ভার বহন করে চলছে বাংলাদেশ। তা সঙ্কটের অবসান বাংলাদেশের চাওয়া হলেও অন্তর্বর্তী সরকার কেন আগুনে পা ফেলতে চাইছে, তা নিয়ে অনেকের মনেই জেগেছে প্রশ্ন।
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে রাখাইন ঘিরে কী হচ্ছে, তা বোঝাটাও জরুরি বলে মত দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
করিডোর আসলে কী
কোনো সংঘাতময় অঞ্চলে যখন খাদ্য ও ওষুধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পৌঁছনো যায় না কিংবা বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন হয়, সেখানে এই বিষয়গুলো সম্পন্ন করার জন্য ‘মানবিক করিডোর’ বা নিরপেক্ষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত নীতির আওতায় এই মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি জরুরি সরবরাহের এমন একটি প্যাসেজ, যার মধ্য দিয়ে ত্রাণসামগ্রী মুক্তভাবে সংঘাতময় এলাকায় যেতে পারে।
সংঘাতময় এলাকায় সবচেয়ে বেশি কাজ করে যে প্রতিষ্ঠান, সেই রেডক্রসের মানবিক করিডোরের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমোদন করা নিরাপদ প্যাসেজ।
মিয়ানমারে গত কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। তাতে রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার। সেখানে এখন আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব চলছে, যারা বিদ্রোহী সরকারের সঙ্গে যুক্ত।
এই অবস্থায় রাখাইনে যুদ্ধপীড়িতদের কাছে ত্রাণসহ মানবিক সহায়তা পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই একটি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা গেলে তা পৌঁছনো সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে এবিষয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না, মানবিক করিডোর স্থাপন করে তাদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের হয়ে কাজ করে আসা মোশতাক আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিশ্বের যেসব জায়গায় এমন মানবিক করিডোর হয়েছে, তার কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোনোটি তৃতীয় পক্ষ- বিশেষ করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে।
তবে অনেক ক্ষেত্রে বিবাদমান পক্ষগুলোকে রাজি করাতে না পারলে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেক সময় এমন প্যাসেজ বানায়, যেখানে বিবদমান সব পক্ষকে সরিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা দেয়া হয়, বলেন ড. রফিকুল ইসলাম।
করিডোর স্থাপন যেভাবে আলোচনায়
রাখাইনের অধিকাংশ এলাকা বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এই দলটির সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছিল। কারণ মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর মতো আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, ফলে এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আসা বন্ধ হচ্ছে না।
গত ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে এক আলোচনা সভায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহফুজুর রহমান মানবিক করিডোর খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
এর পর মার্চে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা উচিৎ বলে মন্তব্য করে।
এর কয়েকদিন পরেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশে আসেন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করতে তিনি কক্সবাজারও যান। তখন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে জন্য একটি করিডোর চালু করতে বাংলাদেশের কাছে প্রস্তাব দেন তিনি।
এরপর গত ৮ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরেন।
তিনি তখন জানিয়েছিলেন যে, মানবিক চ্যানেল বা করিডোর তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মিকে জাতিসংঘই আলোচনায় বসাচ্ছে। আর আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা খলিলুর রহমান আরও জানান, গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথম এসেছিল। তিনি তখন আরাকান আর্মি, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মিয়ানমার সরকার সবার সঙ্গে আলোচনা করেই জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে গিয়েছিলেন।
ঝুঁকি কোথায়
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রভাবশালী পশ্চিমা কয়েকটি দেশ দীর্ঘকাল ধরেই বাংলাদেশের কাছে এমন একটি করিডোর প্রতিষ্ঠার পরামর্শ বা প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। রাজনৈতিক সরকারগুলো ভূ-রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় তাতে কখনো সায় দেয়নি।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, যেসব দেশে এর আগে মানবিক করিডোর পরিচালিত হয়েছে, তার অনেক জায়গায়ই অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি।
“শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি এমন জায়গায় বিবাদমান কোনো কোনো পক্ষের এই প্যাসেজে আক্রমণ করার নজির আছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডোরে হামলায় সিভিলিয়ানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।”
এমন করিডোরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকার কথাও বলেন বিশ্লেষকরা। আবার অস্ত্র পাচার এবং দখল করা এলাকায় জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এই করিডোর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জাতিসংঘে কাজ করে আসা মোশতাক আহমেদ বলেন, “জাতিসংঘ নিজেও অনেক সময় অসহায় থাকে। বৃহৎ শক্তিগুলো যা চায়, তার বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য তার থাকে না। যে কারণে অনেক জায়গায় মানবিক করিডোর প্রয়োজন হলেও করা যায়নি। আবার অনেক জায়গায় করিডোর হলেও সেটি টেকসই ও কার্যকর হয়নি।”
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বুলবুল সিদ্দিকী প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক কলামে লিখেছেন, “মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডোরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া শুরু অস্বাভাবিক নয়।
“এ প্রেক্ষাপটে যদি আরো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়-দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে?”
প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরেকটি কলামে মারুফ মল্লিক রোহিঙ্গা সঙ্কটের পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, অনিশ্চিত রাখাইনে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। এক, রাখাইন মিয়ানমার থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন দেশ বা বিশেষ ব্যবস্থায় পরিচালিত একটি ভূখণ্ডে পরিণত হতে পারে। অথবা মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বা আলোচনার ভিত্তিতে।
মারুফ মল্লিকের ভাষ্যে, “রাখাইনে নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি বা নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে গ্রহণ করবে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।”
ভারতের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তিনি লিখেছেন, “রাখাইনে রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিবর্তন ভারতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হবে। ভারত মিয়ানমারে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারাবে। ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো বাংলাদেশকে এড়িয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরের প্রবেশের সুযোগ হারাবে। তখন অনেক ঘুরে ইয়াঙ্গুন হয়ে সমুদ্রে প্রবেশ করতে হবে।
“এর পাশাপাশি কুকি-চিনদের যুদ্ধের প্রভাব ভারতের পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তাই ভারত চাইবে না মিয়ানমারে এমন কিছু হোক, যাতে তার রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বিঘ্নিত হতে পারে।”

চীনের অবস্থান নিয়ে মারুফ লিখেছেন, “মিয়ানমার নিয়ে চীনের অবস্থান খুবই ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কখন জান্তা সরকারকে সমর্থন দেয়, কখন বিদ্রোহীদের সহায়তা করে, বলা মুশকিল। এর কারণ হচ্ছে চীনের কুমনিং থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশের একটি রুট হচ্ছে রাখাইনের বন্দরগুলো। তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি অংশ হচ্ছে মিয়ানমারের রাখাইনের বন্দর।
“তাই মিয়ানমার হাতছাড়া হয়ে গেলে রাখাইন নিয়ে চীনকে নতুন করে কূটনীতি শুরু করতে হবে। কুমনিং থেকে রাখাইন হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।”
যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে মারুফের ভাষ্য, “যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে বার্মা অ্যাক্ট পাস করেছে। বার্মা অ্যাক্টে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রদানের বিষয়টি ছাড়াও জাতিসংঘের অধিকতর উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে উদ্যোগ গ্রহণে সহায়তা করতে হবে।
“এখন জাতিসংঘের বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মানবিক করিডর সৃষ্টির প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্টের দুটি ধারার সঙ্গে মিলে যায়। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, এই মানবিক করিডোরের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে একটি নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে তারা ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এমন একটি বলয় সৃষ্টি করছে চাইছে, যেখানে ভারতের গুরুত্ব কম থাকবে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিকে ভারতের পক্ষে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করা সম্ভব নয়।”
ফলে মিয়ানমার ঘিরে পরাশক্তিদের এক লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বাংলাদেশের। সেক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে নাজুক সম্পর্কের মধ্যে পশ্চিমাঘেঁষা প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের অবস্থান কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে সবাই।
যে অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা, তার নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নেড়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিশ্বাস।
ক্ষমতা হারানোর দুই মাস আগেই এক সভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাংলাদেশের একটি অংশ এবং মিয়ানমারের একটি অংশ নিেয় একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করেই তিনি বলেছিলেন, “ফিলিস্তিনের মতো বাংলাদেশের একটা অংশ চট্টগ্রাম, মিয়ানমার নিয়ে খ্রিস্টান স্টেট (রাষ্ট্র) বানাবে। বে অফ বেঙ্গলে একটা ঘাঁটি করবে।”
শেখ হাসিনা এটাও বলেছিলেন, “যদিও একটা দেশকে দেখানো হয়, কিন্তু আমি তো জানি তারা কোথায় কোথায় হামলা চালাবে, সেটা তো আমি জানি। সে কারণে আমাদের কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, পড়তে হবে জানি, কিন্তু আমি সেটা পাত্তা দিই না।”
মে মাসে ওই বক্তব্য দেওয়ার এক মাস গড়াতেই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়, তার এক মাসের মধ্যে তা অভ্যুত্থানে রূপ নিয়ে পতন ঘটে শেখ হাসিনার।
রাজনৈতিক দলগুলো কী বলছে
রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশের ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব দলই বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জোর দিচ্ছে।
তৌহিদ হোসেন নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাটি বলার পরপরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “এটা অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা জড়িত।”
এবিষয়ে সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। ফখরুল আরও বলেন, “আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাই না। আমরা আরেকটি যুদ্ধের মধ্যে জড়াতে চাই না। আমাদের এখানে এসে আরও কেউ গোলমাল করুক, সেটিও আমরা চাই না।”
বৃহস্পতিবার ঢাকায় শ্রমিক দলের জনসভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে রাখা বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, অনির্বাচিতদের মাধ্যমে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে না।
“দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ মনে করে, করিডোর দেওয়া-না দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে। সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)সহ বাম দলগুলো এই ধরনের করিডোর স্থাপনে আপত্তি তুলেছে। তারা বলছে, এর মাধ্যমে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডোরের বিষয়টি স্পষ্ট করতে সরকারের প্রতি আহ্বান রেখে ফেইসবুকে পোস্ট দেন।
অভ্যুত্থানকারীদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতারাও মনে করেন, এবিষয়ে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক এতে আপত্তি তুলে বলেছেন, “বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলাম কোনোভাবেই এটি সমর্থন করে না।”
সরকার কী বলছে?
গত ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের জন্য করিডোর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তার ভাষ্যে, “নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ একটা হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।”
এর একদিন পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ফেইসবুক পাতায় লেখেন, রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে এক চরম মানবিক সঙ্কট চলছে বলে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) জানাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশই রাখাইনের ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর একমাত্র কার্যকর পথ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নীতিগতভাবে জাতিসংঘকে ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
ঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সরকার এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি। এটা আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই।
তিনি বলেন, তবে জাতিসংঘের নেতৃত্বে যদি রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
তবে পরে শফিকুল বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে বলেন, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকার সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। উপযুক্ত সময়ে দেশের ভেতরের অংশীজনদের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনা করা উচিৎ।
মারুফ মল্লিক লিখেছেন, “বাংলাদেশ এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আছে যে তাকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতকে হাতে রাখতে হবে রাখাইন ইস্যুতে। ভারতকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে রাখাইন ইস্যুতে ভারসাম্যের মধ্যে আনতে হবে। তাই এ বিষয়ে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে রাজনৈতিক শক্তিকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করলেই ভালো করত।”
বুলবুল চৌধুরীও একই পরামর্শ দিয়ে বলেন, “কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়-দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে।”
জাতিসংঘ কী বলছে
বাংলাদেশের মধ্যে তুমুল আলোচনার মধ্যে গত বুধবার জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশ হয়ে করিডোর করে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে গেলে জাতিসংঘকে দুই দেশের সরকারের অনুমতি পেতে হবে। এই আইনি বাধ্যবাধকতা পূরণ না হলে জাতিসংঘের সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ সীমিত।
রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধরত মিয়ানমার সরকার এই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেবে, সে বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি।
ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর দপ্তর প্রথম আলোকে জানিয়েছে, জাতিসংঘ বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি তারা রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ তার মানবিক অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন জোরদার করবে।
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
রাখাইনে মানবিক করিডোর: অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ, বিতর্ক