প্রথমে হুমকি দিল, এরপর কারখানা বন্ধ করল এস আলম গ্রুপ

বন্ধ ঘোষণার পর এস আলম ফ্যাক্টরি।
বন্ধ ঘোষণার পর এস আলম ফ্যাক্টরি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল এস আলম গ্রুপ; সেই সরকারের পতনের পর পড়েছে এখন চাপে। তার মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে হুমকি দিয়েছিল আন্তর্জাতিক কোনও আদালতে যাওয়ার। এরপর নিজেদের ছয়টি কারখানা বিনা নোটিসে বন্ধ করে দিল চট্টগ্রামভিত্তিক এই শিল্প গ্রুপ।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসা খবরে বলা হয়, মঙ্গলবার চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের ছয়টি কারখানায় গিয়ে শ্রমিকরা দেখতে পায় বন্ধের নোটিস। যেখানে বলা হয়, অনিবার্য কারণবশত কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ খাকবে।

কারখানাগুলো হলো- এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্ট লিমিটেড, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড, এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড, এস আলম পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড ও ইনফিনিটি সি আর স্ট্রিপস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

এই কারখানাগুলোর দুটি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার কালারপুলে, তিনটি ইছানগর, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাঁশখালী উপজেলায়। এসব কারখানায় ১২ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ করে। চাকরি হারানোর শঙ্কায় এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেড কারখানায় বিক্ষোভও করে শ্রমিকরা।

এস. আলম

চার দশক পুরনো এস আলম গ্রুপের অধীন কোম্পানি রয়েছে দুই ডজনের মতো। সেগুলোতে শ্রমিকের মোট সংখ্যা ২ লাখ।

নোটিসে উল্লেখ করা হয়, কারখানার সব শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে অনিবার্যকারণবশত আগামী ২৫ ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকবে। কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত হলে পুনরায় নোটিসের মাধ্যমে জানানো হবে।

কী কারণে বন্ধ করা হলো- সেই বিষয়ে কারখানা কর্মকর্তারা কিছু বলতে পারেননি। তারা বলেছেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মেনে এই নোটিস দেওয়া হয়েছে।

তবে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা স্থানীয় পুলিশকে জানিয়েছেন, কাঁচামাল সঙ্কটের কারণে কারখানাগুলো সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এস আলম গ্রুপের এই বিপত্তির শুরু। তার আগে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদে বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ।

বিভিন্ন কারখানা স্থাপনের পর বিদ্যুৎ কেন্দ্রও তাদের দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। সরকারের ছায়ায় থেকে বেসরকারি সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয় এস আলম।

একচেটিয়া ব্যবসার পাশাপাশি অর্থ পাচারেও সবার আগে আসে এস আলম গ্রুপের নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপ বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে।

গত অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে এস আলমের দখল থেকে ব্যাংকগুলো মুক্ত হয়। এরপর তাদের খেলাপি ঋণের খবরও বেরিয়ে আসতে থাকে।

এরপর দুর্নীতির অভিযোগে গত ১৯ ডিসেম্বর সাইফুল আলম মাসুদ, তার স্ত্রীসহ পরিবারের ৯ সদস্যের ১২৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয় আদালত। তাতেই এস আলম গ্রুপের অর্থের টান পড়ে।

সিঙ্গাপুরে নাগরিকত্ব নেওয়া সাইফুল আলম সেদেশে থেকেই বাংলাদেশে ব্যবসা চালাতেন। দেশে মাঝে-মধ্যে আসতেন। অভ্যুত্থানের পর তিনি বা তার পরিবারের কেউ দেশে আসছেন না।

সিঙ্গাপুরে থেকেই বাংলাদেশে তার সম্পদ ও বিনিয়োগ নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ছয় মাসের সময় বেঁধে দিয়ে সম্প্রতি আইনি নোটিস পাঠান এস আলম। সেখানে তিনি সরকারকে হুমকি দেন, এই সময়ের মধ্যে বিষয়টির সমাধান না হলে আন্তর্জাতিক সালিসিতে যাবেন তিনি।

গত ১৮ ডিসেম্বর পাঠােনা এই নোটিসে সাইফুল দাবি করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তার সম্পদ জব্দ ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ডের কারণে এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগ ও সম্পদমূল্য সম্পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।

নোটিসে আরও বলা হয়, এস আলমের পরিবার ২০১১ সাল থেকে সিঙ্গাপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তারা সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব পেয়েছে। ২০২০ সালে তারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছে।

১৮ ডিসেম্বর এস আলম গ্রুপ নোটিস পাঠানোর পরদিনই তার ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ হয়। তার চার দিন বাদেই ছয়টি কারখানা বন্ধ করে দিলেন তিনি, যাতে কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হলো। 

আরও পড়ুন