বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে ‘আদালতের সঙ্গে উপহাস’ বলে অভিযোগ করেছেন।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো কোনো সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এমন অভিযোগ তুলছেন।
বুধবার এএফপিকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা আরও বলেন, তার বিশ্বাস তাকে দোষী সাব্যস্ত করার রায় আগে থেকেই নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে।
২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৫ আগস্ট থেকে ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন শেখ হাসিনা।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়নে ১৪০০ জন নিহত হয়েছেন।
যদিও ওই প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও তথ্য পর্যালোচনার চিত্র নিয়ে শুরু থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। দলটি বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের প্রভাবে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য ওই প্রতিবেদনে উঠে আসেনি; মৃত্যুর তথ্য নিয়েও রয়েছে গড়মিল।
৭৮ বছর বয়সী বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নিজেও আন্দোলন চলাকালে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন; দিয়েছিলেন আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা।
এএফপিকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারেও তিনি একই বিষয়ের অবতারণা করেছেন।
তিনি বলেন, “সেই ভয়াবহ দিনগুলোতে ছাত্ররা রাস্তায় গুলিতে মারা গিয়েছিল, আমি সেই সমস্ত প্রাণহানির জন্য শোক প্রকাশ করছি।”
তিনি সতর্ক করেন যে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে দেশের ১৭ কোটি মানুষের রাজনৈতিক সংকট আরও ঘণীভূত করেছে, যা ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচনের আগে একটি উদ্বেগজনক ইঙ্গিত।
“প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া, যার মধ্যে আওয়ামী লীগও রয়েছে, নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না,” যোগ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, “আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া, তিনি (ইউনূস) দেশে ভবিষ্যৎ বিভেদের বীজ বপন করছেন।”
“বাংলাদেশের জনগণকে তাদের প্রাপ্য বিকল্প দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে পুনর্বহাল করতে হবে।”
‘রায় পূর্বনির্ধারিত, বিস্মিত হব না’
মানবাধিকার সংস্থাগুলো হাসিনার সরকারকে বিরোধী নেতাদের হত্যা, প্রতিপক্ষ দমন, আদালত নিয়ন্ত্রণ এবং একপেশে নির্বাচনের মতো অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছিল।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার গত মে মাসে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করে, যাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘নির্মম’ হিসেবে অভিহিত করেছে।
“অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রকৃত প্রতিযোগিতা, সব দলের প্রচারণা চালানোর সুযোগ এবং জনগণের বিকল্প বেছে নেওয়ার অধিকার,” যোগ করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “নির্বাচন হলো আদর্শের প্রতিযোগিতা। আপনি কোনো দলের নীতিমালা পছন্দ না করলেই তাকে বাদ দিতে পারেন না।”
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা, যারা দমন-পীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন, এখন তারা নতুন করে সংঘটিত হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) এখন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তাও বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে।
এদিকে শেখ হাসিনা আদালতের আদেশ অনুযায়ী আদালতে হাজির হননি, যেখানে তিনি আন্দোলনের দমনপীড়নে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিনা- সেই অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে মুখোমুখি হচ্ছেন।
প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করেছেন “যার চারপাশে সব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এমন কেন্দ্রীয় চরিত্র” হিসেবে, এবং দোষী প্রমাণিত হলে তার মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছেন।
“এই অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং কোনো প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয়,” বলে দাবি করেছেন শেখ হাসিনা।
“এটি একটি অনির্বাচিত প্রশাসন দ্বারা গঠিত আদালত, যেখানে আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমাকে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধে অনুপস্থিত অবস্থায় বিচার করছে।”
আগামী ১৩ নভেম্বর ওই রায় ঘোষণার জন্য তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। অবশ্য এরইমধ্যে বিচারালয়ে রাষ্ট্র নিযুক্ত শেখ হাসিনার আইনজীবীর সঙ্গে বিচারকের কথোপকথনের একটি ভিডিও ফাঁস হলে তা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। আওয়ামী লীগ ছাড়াও অনেকেই এই বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “রায়টি দুঃখজনকভাবে পূর্বনির্ধারিত, এবং এটি ঘোষিত হলে আমি বিস্মিত হব না।”
‘গুলি চালানোর নির্দেশের কথা মিথ্যা’
রাষ্ট্রীয়ভাবে হাসিনার পক্ষে নিযুক্ত আইনজীবী আদালতে বলেছেন যে তিনি কেবলমাত্র “একটি নিরপেক্ষ প্রক্রিয়াকে” স্বীকৃতি দেবেন, যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কর্তৃক পরিচালিত বিচার।

যদিও রাষ্ট্র নিযুক্ত ওই আইনজীবী হাসিনার পক্ষে লড়ছেন নাকি তার বিরুদ্ধে সাজার রায় বাস্তবায়নে কাজ করছেন- এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আসছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
শেখ হাসিনা বলেন, “যে অভিযোগটি করা হয়েছে যে আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।”
অবশ্য ‘চেইন অব কমান্ডে’ ভুল থাকার কথা অস্বীকার করেননি তিনি।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তবে সামগ্রিকভাবে, সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো ছিল পরিস্থিতি অনুযায়ী যুক্তিসঙ্গত, সদিচ্ছা থেকে নেওয়া, এবং প্রাণহানি কমানোর উদ্দেশ্যে।”
আওয়ামী লীগের দাবির বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলে আসছে, বিচারটি ন্যায়সংগত, তারা পুলিশের যাচাই করা অডিও টেপ বাজিয়েছেন, যেখানে শোনা যায় হাসিনা সরাসরি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে “প্রাণঘাতি মারণাস্ত্র” ব্যবহার করতে বলছেন।
হাসিনা দাবি করেছেন, রেকর্ডগুলো অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।”
তিনি তার পতনের পর থেকে তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে চলা দমন-পীড়নের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। বিশেষ করে যখন গত ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তা বাহিনী “অপারেশন ডেভিল হান্ট” চালিয়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা দেশকে “অস্থিতিশীল করার” চেষ্টা করছিলেন।
একই সঙ্গে তার শাসনামলে গুম ও নিখোঁজের ঘটনার অভিযোগ সম্পর্কে কোনো তথ্য দেননি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
চলতি মাসের শুরুতে আওয়ামী লীগের আইনজীবীরা মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আইসিসিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন “প্রতিশোধমূলক সহিংসতার” ঘটনা তদন্তের অনুরোধও জানানো হয়েছে।
এর মধ্যে ‘মব সন্ত্রাসের’ মাধ্যমে পিটিয়ে হত্যার মতো অভিযোগও রয়েছে। আওয়ামী লীগের নিয়োগ করা ব্যারিস্টার স্টিভেন পাউলস কেসি বলেন, “বাংলাদেশে বিচার হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা নেই।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এএফপির প্রশ্নের উত্তরে হাসিনা বলেন, “আমার অগ্রাধিকার এখন বাংলাদেশের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতা।”
এ সম্পর্কিত আরও খবর:



