ইউক্রেনের সাহসী ড্রোন হামলা মস্কোকে যতটা আঘাত করেছে, তারচেয়েও বেশি করেছে বিব্রত। কীভাবে ১৮ মাস ধরে চলতে থাকা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালাল, তা বিস্মিত করেছে রুশ জেনারেলদের।
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এমন দুর্বলতা অতীতে দেখা যায়নি। তবে সমর বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনের এই হামলা পশ্চিমা মিত্রদের জন্যও একটি বিপদ উন্মোচন করেছে। অল্প খরচে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চালানো হামলা এখন সবচেয়ে সুরক্ষিত পরাশক্তিকেও মারাত্মকভাবে আঘাত করতে পারে।
ইউক্রেন সস্তা ড্রোন ব্যবহার করে গত রবিবার রাশিয়ার ভেতরে থাকা বিমান ঘাঁটিতে থাকা ডজনখানেক যুদ্ধবিমান লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে বলছে, হামলায় রাশিয়ার এক ডজনের বেশি বোমারু বিমান ধ্বংস হয়েছে। আর নিঃসন্দেহে এটি ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য বড় ধাক্কা, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে।
এই ড্রোনগুলো এখন অসম যুদ্ধের মূল অস্ত্র হয়ে উঠেছে। এই ধরনের যুদ্ধে এক পক্ষের সামরিক শক্তি, সম্পদ কিংবা কৌশল অন্য পক্ষের চেয়ে অনেকটাই কম বা ভিন্ন হয়। বহু বছর ধরে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের বিপুল সম্পদ ও আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে এই ধরনের বৈষম্যমূলক যুদ্ধে এগিয়ে ছিল।

কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়ন ও যুদ্ধক্ষেত্রে উদ্ভাবনের ফলে সেই হিসাব উল্টে গেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা পিছিয়ে পড়েছে। সামরিক নেতাদের মতে, এই পরিবর্তনের গতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনও দেখা যায়নি।
সোমবার এক সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল র্যান্ডি জর্জ বলেন, “আমাদের আরও চটপটে হতে হবে। ড্রোন প্রযুক্তি ক্রমাগত বদলে যাবে।” তিনি আরও বলেন, ইউক্রেনের এই হামলা প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের ফলে যুদ্ধক্ষেত্র কেমন বদলে যাচ্ছে তার একটি বড় উদাহরণ।
কম দামে পাওয়া বাণিজ্যিক ড্রোন ও ডিজিটাল যন্ত্রের কল্যাণে বিদ্রোহী, সন্ত্রাসী সংগঠন এবং ইউক্রেনের মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সামরিক বাহিনীও এখন এমন সামরিক সাফল্য পাচ্ছে, যা কয়েক বছর আগেও কল্পনা করা যেত না।
ইউক্রেন জানিয়েছে, তারা রবিবারের হামলায় চারটি রুশ ঘাঁটির ওপর ১১৭টি ছোট ড্রোন পাঠায়। প্রতিটি ড্রোনের দাম ছিল আনুমানিক ২,০০০ ডলার। পুরো অভিযানের অন্যান্য খরচ ধরেও ইউক্রেনের মোট ব্যয় এক মিলিয়ন ডলারের কম ছিল। অথচ এই অভিযানে ধ্বংস হওয়া রুশ যুদ্ধবিমানের বাজারমূল্য ছিল এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এমন বিমান রাশিয়ার পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে পুনরায় তৈরি করা সম্ভব নয়।
এই আক্রমণের প্রভাব আরও বাড়ানো হয় প্রচারের মাধ্যমে। ইউক্রেন এই অভিযানের ভিডিও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাশ করে। এখন তথ্য সহজে ছড়িয়ে পড়ায় গোপন অভিযানগুলো বিশ্বব্যাপী এক নতুন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের রূপ নিচ্ছে, যা আগে সম্ভব ছিল না।
দ্বৈত-ব্যবহারের প্রযুক্তি, যেমন বাণিজ্যিক ড্রোন ও রাইড-শেয়ারিং সেবায় ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক সফটওয়্যার, ইউক্রেনকে ২০২২ সালের রাশিয়ার বিশাল আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করেছে। এই প্রযুক্তিগুলো তাদের একটি বড় সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।
এই ধরনের অনেক কিছুই ইউক্রেনের সাম্প্রতিক হামলায় দেখা গেছে। ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা এই গোপন অভিযানটি চালাতে পেরেছে মূলত বেসামরিক প্রযুক্তির সামরিক ব্যবহার সম্পর্কে তাদের ভালো জ্ঞানের কারণে। মনে করা হচ্ছে, তারা জনসাধারণের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ড্রোনগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ই এই যুদ্ধে ড্রোনের নকশা, সেগুলোর প্রতিরক্ষা ও বৈদ্যুতিক যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। এই প্রতিযোগিতা অন্য দেশগুলোর জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে উঠেছে—যেখানে ভবিষ্যতের যুদ্ধে প্রযুক্তি ও কৌশলের ভয়াবহতা প্রকাশ পাচ্ছে।
বুধবার ন্যাটোতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ম্যাথিউ হুইটাকার বলেন, “আমরা আধুনিক যুদ্ধের প্রতিটি পাঠ শিখতে চাই—এই যুদ্ধ কত দ্রুত পরিবর্তিত হয় এবং আমাদের কীভাবে উদ্ভাবনী হতে হবে, সেটি বুঝতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ড্রোন ব্যবহারে ব্যাপক বৃদ্ধি আনতে চায়। এটি পেন্টাগনের একটি বড় পরিবর্তনের অংশ। আগে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ও আফগানিস্তানে অত্যন্ত উন্নত ড্রোন ব্যবহার করত। এর মধ্যে ছিল আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক। এটির পাখার দৈর্ঘ্য একটি বোয়িং ৭৩৭ যাত্রীবাহী বিমানের সমান। আর এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন থেকে জেট যুদ্ধবিমানে ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা যায়। এই প্রতিটি ড্রোনের দাম ছিল কোটি কোটি ডলার।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এমন ড্রোন তৈরি করছে, যেগুলো ছোট, দ্রুত পরিবর্তনযোগ্য ও ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া যায়। ইউক্রেনের মতো হামলা থেকে পাওয়া শিক্ষা এদের ডিজাইন ও কৌশলে প্রভাব ফেলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ইউরোপ ও আফ্রিকার কমান্ডার জেনারেল ক্রিস্টোফার ডনাহু বলেন, “এই উদাহরণ দেখায় কীভাবে যুদ্ধপ্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে। এটি প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস করতে ও প্রতিরোধের খরচ কমাতে সহায়তা করছে।”

ন্যাটো জোটের অন্যান্য দেশগুলোও একই ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। এর মধ্যে আছে জার্মানি। দেশটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি হলেও ন্যাটোর মধ্যে সবচেয়ে ধীর গতির সামরিক সংস্কারকারী।
জার্মানির সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা কারস্টেন ব্রয়র বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হলো—উদ্ভাবনের সময়কাল সংক্ষিপ্ত ও দ্রুত করতে হবে।
তিনি বলেন, “ইউক্রেনে শিল্প ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সরাসরি সংযোগ রয়েছে। আমাদের এটি করতেই হবে, যদিও আমাদের নিজস্ব কোনও ফ্রন্টলাইন নেই।”
গত মার্চের শেষ দিকে জার্মান সেনাবাহিনী এক ধরনের ড্রোন সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি জানান, এই ‘লোইটারিং মুনিশন’ ড্রোনগুলো বছরের শেষ নাগাদ সেনাদের হাতে পৌঁছে যাবে। এটি একটি বড় রকমের গতি বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
তবে শুধু অস্ত্র সংগ্রহ ও বিতরণ যথেষ্ট নয়। ইউক্রেনের এই হামলা আরও দেখিয়েছে, সামরিক অভিযান ও কৌশলেও কী ধরনের উন্নতি হয়েছে।
অনিয়মিত যুদ্ধের ধারণা একেবারেই নতুন নয়। ইউক্রেন যুদ্ধ দেখাচ্ছে কীভাবে সেনাবাহিনী প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং গোপন অভিযান ব্যবহার করে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। আসলে এই কৌশল বহু বছর ধরেই সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে আসছে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলা ছিল অনিয়মিত ও অসম যুদ্ধের সবচেয়ে চরম উদাহরণ। এই হামলার জন্য সংগঠকদের অর্থনৈতিক খরচ ছিল খুবই কম। কিন্তু এর ঐতিহাসিক প্রভাব ছিল বিশাল। তবে সেই হামলা আত্মঘাতী হামলাকারীদের দরকার হয়েছিল। এখন ড্রোন ও অন্যান্য নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আক্রমণকারীরা বড় আঘাত হানতে পারে, নিজেরা অজ্ঞাতনামা ও নিরাপদ অবস্থানে থেকে।
ড্রোনসেক নামক একটি হুমকি-গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মাইক মোননিক বলেন, “মূল বিষয়টা হলো—কীভাবে আমরা মানুষকে বাদ দিয়ে প্রযুক্তিকে দিয়ে সেই কাজ করাতে পারি। ইউক্রেনের ড্রোন হামলা এখন একটি বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ।”
ইসলামিক স্টেট ছিল প্রথম দলগুলোর একটি যারা বাণিজ্যিক ড্রোনকে অস্ত্রে পরিণত করেছিল। এটি ঘটে প্রায় এক দশক আগে ইরাকে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলার সময় হামাস প্রথমেই ধীরগতির স্বল্পমূল্যের ড্রোন পাঠায়। এই ড্রোনগুলো গাজা সীমান্তে থাকা ইসরায়েলের উন্নত স্বয়ংক্রিয় প্রহরী টাওয়ারগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরাও সহজ ড্রোন ব্যবহার করে বিশ্বজুড়ে নৌ চলাচলে এবং পশ্চিমা নৌবাহিনীর ওপর বড় ধরনের ক্ষতি করেছে।
এমন আরও অনেক ড্রোন হামলা দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। মিয়ানমারে বিদ্রোহীরা আলিবাবা থেকে কেনা ৬০০ ডলারের কৃষি কাজে ব্যবহৃত ড্রোন পরিবর্তন করে সেটিতে অনিয়ন্ত্রিত রকেট বসিয়ে দেয়। এতে করে সেটি হয়ে ওঠে একপ্রকার ক্ষুদ্র আকারের আক্রমণকারী হেলিকপ্টার।

ইসরায়েলে এক অপরাধী দল ড্রোনে বিস্ফোরক বসিয়ে সেটিকে প্রতিপক্ষ গ্যাং নেতার ১৩তলার জানালার বাইরে উড়িয়ে দেয়। এটি ছিল একটি হত্যাচেষ্টার অংশ।
ইউক্রেনও এই ধরনের উদ্ভাবন করেছে। তবে তারা একটি বাড়তি কৌশল প্রয়োগ করেছে—হামলার ভিডিও দ্রুত অনলাইনে প্রকাশ করে আন্তর্জাতিকভাবে এর প্রভাব বহুগুণে বাড়ানো।
প্রধান নির্বাহী মাইক মোননিক বলেন, “আসলে এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক কৌশল।” ভিডিও প্রকাশের মাধ্যমে ইউক্রেন তাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন করতে চায়। একই সঙ্গে রাশিয়াকে ভয় দেখাতে চায়, যাতে তারা মনে করে—“এখন আমাদের প্রতিটি ট্রাক তল্লাশি করতে হবে, প্রতিটি বিমান ঘাঁটি পাহারা দিতে হবে,” কারণ এই ছোট ড্রোনগুলো এখন আর কোনও লক্ষ্যকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখে না।
উন্নত ওয়্যারলেস প্রযুক্তি শুধু দুর্বল পক্ষের সুবিধা দেয় না। ২০২৩ সালে ইসরায়েল লেবাননে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের ওপর একটি অত্যন্ত উন্নত গোপন হামলা চালায়। তারা হিজবুল্লাহ সদস্যদের ওয়াকি-টকি ও পেজারে লুকানো বিস্ফোরক বসিয়েছিল। পরে দূর থেকে নিয়ন্ত্রিতভাবে সেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
তথ্যসূত্র : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।