যুক্তরাষ্ট্রের দুয়ার বন্ধ, শরণার্থীরা সব যাচ্ছে কোথায়

IOM ppn

কোস্টারিকার উত্তরের প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে একটি মেঠো রাস্তা চলে গেছে। এই প্রধান সড়কটি দেশটিকে নিকারাগুয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। আর সেখানেই লাস টাব্লিয়াস সীমান্ত চেকপোস্ট অবস্থিত।

প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতে রিও ফ্রিও নদী প্লাবিত হলে এর চারপাশের নিচু বনভূমি পানিতে ডুবে যায়। তখন এই মাটির রাস্তাটি কাদায় পরিণত হয়। এই কাদা এতটা আঠালো হয়ে পড়ে যে, সীমান্ত পার হওয়া অভিবাসীদের জুতো টেনে ধরে রাখে। অনেক সময় তারা সীমান্ত পার হওয়ার পর নিজেদের নষ্ট হয়ে যাওয়া স্নিকার জুতো ফেলে রেখে যায়।

গত মাসে শরণার্থীবিষয়ক গবেষক জাস্টিন গেস্ট ওই এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তখন তিনি শত শত ফেলে রাখা জুতো দেখতে পান। ওই জুতোগুলো রোদে পোড়া ও ধুলায় মোড়া ছিল। কিন্তু যে বিষয়টা জাস্টিনকে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছে, তা হলো—এই সব জুতো সীমান্তের দক্ষিণ পাশে স্তূপ করে রাখা ছিল। এর মানে হলো, যারা এই জুতো পরেছিল তারা নিকারাগুয়া থেকে দক্ষিণ দিকে, অর্থাৎ কোস্টারিকায় প্রবেশ করেছে।

জুতোর স্তূপ যেন একটি নিঃশব্দ স্মৃতিস্তম্ভ। এটি মানব অভিবাসনের এক ব্যতিক্রমী পরিবর্তনের চিহ্ন বহন করছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, মধ্য আমেরিকার ভেতর দিয়ে মানুষ এখন বেশি দক্ষিণ দিকে যাত্রা করছে। 

এই নতুন অভিবাসন প্রবাহ শুরু হওয়ার পেছনে কারণ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া সীমান্ত নীতি। তারা বৈধ ও অবৈধ উভয় ধরনের প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। এর প্রভাব মধ্য আমেরিকার ভেতরে ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

গত কয়েক বছরে লাখ লাখ মানুষ লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা হয়ে ভয়ংকর দারিয়েন জঙ্গল পার হয়ে পানামা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে রওনা দিত। কিন্তু এখন সেই বিশাল অভিবাসন প্রবাহ কমতে শুরু করেছে।

কোস্টারিকা এই পরিবর্তনের একটি উদাহরণ। অনেক বছর ধরে প্রতিদিন শত শত বা কখনও হাজার হাজার অভিবাসী বাসে করে দেশটির দক্ষিণ প্রান্তের পাসো কানোয়াস থেকে উত্তর প্রান্তের লোস চিলেস পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মাইল পথ পাড়ি দিত। 

জাতিসংঘ-সমর্থিত আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ১২ লাখেরও বেশি মানুষ পানামা থেকে উত্তরমুখে কোস্টারিকায় প্রবেশ করেছিল।

তবে ২০২৩ সালের আগস্টে অভিবাসন সংখ্যা ৮৪,৫০০-তে পৌঁছায়, এরপর তা কমতে শুরু করে। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে সেই সংখ্যা ১৪,৪০০-তে নেমে আসে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার মাসে সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ১,৬০০-তে। ফেব্রুয়ারিতেও সংখ্যাটি ১,৬০০ ছিল। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে এসে উত্তরমুখী অভিবাসনের সংখ্যা দাঁড়ায় শূন্যে।

অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মধ্যে ছয় সপ্তাহে প্রায় ১,২০০ মানুষ দক্ষিণ দিক থেকে কোস্টারিকায় প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে আইওএম।

এই পরিবর্তন এখন কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং এটি মধ্য আমেরিকার অভিবাসনের গতিপথ বদলে দিয়েছে।

গুয়াতেমালা এবং কলম্বিয়াসহ ওই অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও অভিবাসনের গতিপথে পরিবর্তন দেখা গেছে। এসব দেশে দক্ষিণমুখী অভিবাসীর সংখ্যা এ বছর এখন পর্যন্ত আরও বেশি রেকর্ড হয়েছে। 

পানামার সরকার জানিয়েছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫,১০০ জন দক্ষিণমুখী অভিবাসীর হিসাব তারা রেখেছে। কোস্টারিকার মতো পানামাতেও উত্তরমুখী অভিবাসনের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে যেখানে এই সংখ্যা ছিল ১,১০,৫৭২ জন, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২,৮৩৮ জনে।

তবে কোস্টারিকার আইওএমের তথ্য সব সময় সম্পূর্ণ নয়। তারা রাতের বেলায় বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনে প্রবেশ করা অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করে না। পাশাপাশি সব প্রবেশপথ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে না।

গত মাসে কোস্টারিকায় জাস্টিন দুই ডজনেরও বেশি অভিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই তাদের উত্তরমুখী যাত্রা থামিয়ে দিয়েছেন অথবা মেক্সিকো থেকে ফিরে এসেছেন। তারা মেক্সিকোতে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকার কখনোই হয়নি।

বাস কোম্পানিগুলো এখন নতুন অভিবাসন প্রবাহ সামাল দিতে লোস চিলেস থেকে দক্ষিণের শহরগুলোর দিকে অতিরিক্ত রুট চালু করেছে। এসব রুট কেসাডা ও রাজধানী সান হোসের মতো শহরগুলোর দিকে যাচ্ছে।

লোস চিলেস ও লাস টাব্লিয়াসের বাস টার্মিনালগুলোতে সাংবাদিক জাস্টিন এমন কিছু মানুষকে দেখেছেন যাদের “কয়োট” বলা হয়। এরা হলো মানুষ পাচারের সঙ্গে যুক্ত দালাল। তারা আগে অভিবাসীদের উত্তর দিকে নিয়ে যেত। এখন তারা অভিবাসীদেরকে দক্ষিণ দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে।

অভিবাসীরা সবাই জানতেন, ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন-বিরোধী। তারা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর খবরগুলোও জানতেন। তাদের অধিকাংশই শুধু এই কারণেই ফিরে যাচ্ছেন যে তারা মনে করেন, এখন যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা আর সম্ভব না।

বাইডেন প্রশাসনের আমলে কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপের পর থেকেই আশ্রয় প্রার্থনার হার কমে আসে। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি বড় পরিবর্তন ঘটে। তিনি বাইডেন প্রশাসনের তৈরি করা একটি অ্যাপ বন্ধ করে দেন, যার মাধ্যমে অভিবাসীরা সাক্ষাৎকারের জন্য সময় নির্ধারণ করতে পারতেন।

অভিবাসীরা জানিয়েছেন, তারা কেউ কেউ নয় মাস পর্যন্ত সেই সাক্ষাৎকারের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু যখন দেখা গেল সাক্ষাৎকার বাতিল হয়েছে, তখন তারা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এখনও কিছু অভিবাসী অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে এর জন্য তাদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়—যা তাদের অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব নয়। 

সম্প্রতি এল পায়েস নামে একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মেক্সিকোর টিজুয়ানায় একজন অভিবাসীর জন্য এই পাচারের খরচ ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ ডলারের মধ্যে হতে পারে।

অভিবাসীরা বলছেন, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর আগেই আরেকটি বড় কারণ দক্ষিণমুখী অভিবাসনের পেছনে কাজ করছে। তা হলো—মেক্সিকোতে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি। 

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মেক্সিকো সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সহায়তায় সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অভিবাসীদের সরিয়ে দিতে শুরু করে। মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলে অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তা মাদকচক্রের সহিংসতা উপেক্ষা করেন। সেখানে অপরাধীরা অভিবাসীদের অপহরণ ও অর্থ আদায় করতে শুরু করে। যারা যুক্তরাষ্ট্রে আত্মীয়-স্বজন আছে বলে মনে হয়, তারা বিশেষভাবে অপহরণের শিকার হন। অনেক অভিবাসী জানিয়েছেন, মেক্সিকোতে তারা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, যা তাদের নিজ দেশ ত্যাগের কারণের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল।

২৫ বছর বয়সী আবিসমায়েল একজন ভেনেজুয়েলান গাড়ি মেকানিক। সে তার পুরো নাম প্রকাশ করেনি, কারণ সে প্রতিশোধের আশঙ্কা করছে। 

সম্প্রতি তিনি মেক্সিকোর টাপাচুলায় একটি গ্যারেজে কাজ করতেন। তিনি জানান, খাবার ও থাকার জায়গার বিনিময়ে সপ্তাহে সাত দিন, প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা করে কাজ করতে হতো। এর বিনিময়ে সে মাত্র ১৫ ডলার সাপ্তাহিক ভাতা পেত।

এই বছর একদল সশস্ত্র মাদকচক্র সদস্য আবিসমায়েল, তার ভাই, ভাবি ও পাঁচ ভাগ্নে-ভাগ্নিকে অপহরণ করে। অপহরণকারীরা বন্দুকের নল পিঠে ঠেকিয়ে তাকে হুমকি দেয় এবং বারবার বলে—“প্লাতা ও প্লোমো” অর্থাৎ “টাকা দাও, না হয় গুলি খাও।” এমনকি তারা তার চার বছর বয়সী ভাগ্নেকে উদ্দেশ করে চিৎকার করে বলে—“তোর মা মরে যাক, আমার টাকা দে!”

শেষ পর্যন্ত তারা মুক্তি পায়। কারণ আবিসমায়েলের মা ভেনেজুয়েলার কারাকাস শহরে পরিবারের ফ্রিজ বিক্রি করে সেই অর্থ পাঠায়।

নিকারাগুয়া সীমান্ত থেকে তিন মাইল দক্ষিণে লোস চিলেস বাস টার্মিনালে আবিসমায়েলের সঙ্গে দেখা হয় জাস্টিনের। সেখানে তিনি একটি প্লাস্টিকের বেসবল বল ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন। আর তার ভাগ্নে গাছের ডাল দিয়ে বল মারছিল।

স্থানীয় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি ভরে যাওয়ায়, তারা এখন স্থানীয় এক বাজারের করিডোরে রাত কাটাচ্ছে। তবে আবিসমায়েল জানায়, তারা কোস্টারিকায় আশ্রয়ের আবেদন করবে এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে থাকতে চায়।

তিনি বলেন, “মেক্সিকো পার হওয়ার পর যখন এখানে এসে একটু নিঃশ্বাস নিই, মনে হয় যেন বাতাসটাই বদলে গেছে। এটা একদম আলাদা একটা জগৎ। আমরা রাস্তায় হাঁটতে পারি। এখানে আমাদের খাবার, পানি, শৌচাগার দেওয়া হয়। সত্যি বলতে, আমরা শুধু শান্তি চাই। আমরা যা করতে পারি করব। শুধু চাই সৎভাবে কাজ করতে।”

যেসব অভিবাসী দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে, তাদের জন্য কোস্টারিকা স্বাভাবিকভাবেই আশ্রয় নেওয়ার একটি উপযুক্ত দেশ। এটি মধ্যম আয়ের একটি রাষ্ট্র এবং মধ্য আমেরিকার একমাত্র স্থিতিশীল গণতন্ত্র।

অনেক অভিবাসী দক্ষিণ আমেরিকায় ফিরে যেতে পানামার জঙ্গল পার হতে চান না। আবার মধ্য আমেরিকার অন্যান্য দেশ—গুয়াতেমালা, এল সালভাদর, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়ার অবস্থাও মেক্সিকোর মতোই খারাপ।

কোস্টারিকায় আইওএম পরিচালিত একটি অপ্রকাশিত জরিপের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, দক্ষিণমুখী অভিবাসীদের মধ্যে ২২ শতাংশ কোস্টারিকায় থেকে যেতে চান। বাকি ৭৩ শতাংশ আরও দক্ষিণে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।

একজন অভিবাসন গবেষক হিসেবে কোস্টারিকার আইওএম অফিসকে তথ্য সংগ্রহে পরামর্শ দেন জাস্টিন। এজন্য তিনি কোনও পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন না। এই কারণে তাদের গবেষণার ফলাফলের অ্যাক্সেস তার রয়েছে।

কোস্টারিকা খুব দ্রুত চাপের মুখে পড়ছে। গত মাসে দেশটির সরকারের অভিবাসন নীতির দায়িত্বে থাকা উপমন্ত্রী জানান, প্রায় ৫১ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটি বর্তমানে ২ লক্ষাধিক আশ্রয়প্রার্থীর আবেদন প্রক্রিয়াকরণে ব্যস্ত। 

সেখানকার আইওএম কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশটির আশ্রয়প্রক্রিয়া বর্তমানে নয় মাস পিছিয়ে রয়েছে। সাতটি আশ্রয়কেন্দ্রের একটিতেও খালি জায়গা নেই।

মেক্সিকো থেকে উল্টো দিকের অভিবাসনের যে প্রবাহ শুরু হয়েছে, তা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। 

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত, মেক্সিকো কর্তৃপক্ষ প্রায় ৯ লাখ অনিয়মিত অভিবাসীর উপস্থিতি নথিভুক্ত করেছে। তারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া দেশটিতে অবস্থান করছিল। শুধু ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসেই প্রায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার এমন অভিবাসীকে মেক্সিকোর নিরাপত্তা বাহিনী আটক করে। 

এই বিপুল সংখ্যক মানুষের একটি বড় অংশ যদি আগামী মাসগুলোতে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে, তবে কোস্টারিকাসহ লাতিন আমেরিকার আরও কিছু দেশে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এর আগেও ২০১৯ সালে ৬০ হাজার নিকারাগুয়ান নাগরিক গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে কোস্টারিকায় আশ্রয় চেয়েছিল, তখনও দেশটির আশ্রয়ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

কোস্টারিকার সরকারি কর্মকর্তারা স্বীকার করছেন, তারা এই পরিস্থিতির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নন। 

সান হোসে শহরে তার কার্যালয়ে জাস্টিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাদিলা বলেন, “আমরা একটি ঢেউ আশা করছি—একটি বিশাল ঢেউ। আমাদের বিশ্বাস, অভিবাসীরা এখন মেক্সিকো ও নিকারাগুয়ার মধ্যে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কোনো এক সময় তারা হঠাৎ করেই কোস্টারিকায় ঢুকে পড়বে।”

তিনি দৃঢ়ভাবে জানান, কোস্টারিকাকে তখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে, যাতে সরকারের পক্ষে সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি, খাবার, চিকিৎসা সহায়তা, পোশাক ও প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করা সম্ভব হয়। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “আমাদের এই সামর্থ্য নেই।”

দেশটির মানবাধিকার রক্ষা ও সরকারের জবাবদিহিতার দায়িত্বে থাকা ওমবাডসম্যানের কার্যালয় সম্প্রতি সরকারের কিছু ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করেছে। বিশেষ করে, কোস্টারিকায় আটক অভিবাসীদের সঙ্গে আচরণ এবং তাদের পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথিপত্র কেড়ে নেওয়ার ঘটনা নিয়ে তারা উদ্বেগ জানিয়েছে।

বাদিলা আশঙ্কা প্রকাশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে দিতে থাকে এবং তাদের দক্ষিণে পাঠিয়ে দেয়, তাহলে এতে কোস্টারিকায় চলমান মানবিক সংকট আরও খারাপ হবে। 

তবুও তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত কোস্টারিকা নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যসহ নানা বিষয়ে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো চাভেস রব্লেস বলেন, দেশটি “উত্তরের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভাই”-এর সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কৃত অভিবাসীদের বহনকারী ফ্লাইট গ্রহণ করবে।

তবে মানবাধিকার আইনজীবীরা কোস্টারিকা ও পানামার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। 

তাদের অভিযোগে বলা হয়েছে, এই দেশগুলো অভিবাসীদের (শিশুসহ) আটক করে তাদের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। মামলাগুলো এখনো বিচারাধীন। তবে এসব মামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী বহনকারী ফ্লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কোস্টারিকা ও পানামা সরকার দাবি করেছে, তারা কাউকে জোরপূর্বক আটক রাখছে না।

প্রেসিডেন্ট চাভেসের মনোনীত প্রতিনিধি হলেন বাদিলা। তিনি ২০২২ সালের নির্বাচনে দুর্নীতিবিরোধী প্রচারের মাধ্যমে বিজয়ী হওয়া মধ্যপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেস পার্টির সদস্য। 

তিনি জানান, কোস্টারিকায় এখনই বিদেশি-বিদ্বেষ বা জেনোফোবিয়া বাড়তে শুরু করেছে। তিনি মনে করেন, ২০২৬ সালের নির্বাচনের মুখোমুখি তার দল অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়গায় যেভাবে মধ্যপন্থী সরকারগুলো লোপ পেয়েছে, কোস্টারিকায়ও তেমনটি হতে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো এ খবর শুনে সন্তুষ্ট হবে যে, অনেক অভিবাসী এখন উত্তরমুখী যাত্রা থেকে ফিরে আসছে। কিন্তু এতে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের ক্ষতি করতে পারে। 

কোস্টারিকার যুক্তরাষ্ট্রবান্ধব সরকার ক্ষমতা হারালে সেখানে একটি দুর্বল রাষ্ট্র বা চীনের ঘনিষ্ঠ কোনো সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয়প্রার্থী ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে অনেক অভিবাসী বাধ্য হয়ে চোরাপথে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করবে। এতে তারা মেক্সিকোর ভয়ংকর অপরাধী চক্রের হাতে আরও বেশি শোষণের শিকার হবে, যাদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। 

ট্রাম্পের এই নীতিমালা যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করছে। যুক্তরাষ্ট্র এতদিন ছিল নিপীড়িত মানুষের জন্য আশ্রয়ের প্রতীক। সেখানে তারা স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের খোঁজে আশ্রয় নিতে পারত। এখন সেই ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে অন্য দেশগুলোও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করে অভিবাসন নীতিতে কঠোর হতে পারে।

ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, দক্ষিণ সীমান্তে তার কথিত “আক্রমণ” বন্ধ হওয়ার পরেই কেবল সীমান্তে আরোপিত কড়াকড়ি শিথিল করা হবে। কিন্তু এখন বহু অভিবাসী দক্ষিণে ফিরে গেলেও, পশ্চিম গোলার্ধে মানবিক সঙ্কট থেকে যাচ্ছে এবং তা চলতেই থাকবে।

আরও পড়ুন