বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭ থেকে শুরু করে টরাস নাইন এমএম পিস্তল রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ‘ছোট সাজ্জাদ’ বাহিনীর কাছে। এসব অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম দাপিয়ে বেড়িয়েছে ‘ছোট সাজ্জাদ’। নিয়ন্ত্রণ করতেন বায়েজিদ, চান্দগাঁও এলাকায় চাঁদাবাজি ও ঝুট ব্যবসা।
বিদেশে পলাতক ‘শিবির ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলীর অনুসারী ‘ছোট সাজ্জাদ’ নিজেকে শিবিরের ক্যাডার হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
সাজ্জাদ হোসেন হাটহাজারীর শিকারপুর গ্রামের সোনা মিয়া সওদাগর বাড়ির মো. জামালের ছেলে। তাকে স্থানীয়ভাবে বুড়ির নাতি সাজ্জাদ হিসেবেও চেনেন অনেকে। তার বিরুদ্ধে তিনটি খুনসহ ১৫টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
দীর্ঘদিন চট্টগ্রামের মূর্তমান আতঙ্ক সাজ্জাদ বাহিনী এসব অস্ত্র কোথায় পেয়েছেন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে পুলিশ। সাজ্জাদের পেছনে শক্তি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নাম শোনা গেলেও সে নাম আর সামনে আনছে না চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ। তাদের ভাষ্য, “সন্ত্রাসীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।”
কে এই ছোট সাজ্জাদ
চট্টগ্রামের একসময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খান। আলোচিত এইট মার্ডার মামলার দণ্ডিত এই আসামি ২০০০ সালে একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তবে নগরীর বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায় এখনও কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি বেচাকেনা করলেই ফোন আসে সাজ্জাদের। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলে শিষ্যদের দিয়ে হামলা করাতেন।
দুই দশকের বেশি এভাবেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন সাজ্জাদ। ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে নুরুন্নবী ম্যাক্সন ভারতে গিয়ে মারা গেছেন। একাধিকবার গ্রেপ্তারের পর দলছুট ঢাকাইয়া আকবর। সারোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা পক্ষ ত্যাগ করে বাহিনী গড়েছেন। ফলে ছোট সাজ্জাদকে শিষ্য হিসেবে গড়ে তোলেন বড় সাজ্জাদ।
বর্তমানে নগরীর অক্সিজেন-কুয়াইশ এলাকার আধিপত্য নিয়ে লড়াই চলছে ছোট সাজ্জাদ ও বাবলার মধ্যে। এরই জেরে গত বছরের ২৯ আগস্ট রাতে কুয়াইশ-অক্সিজেন সড়কে মো. আনিস (৩৮) ও মাসুদ কায়ছারকে (৩২) গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পৃথক মামলাতেই আসামি সাজ্জাদ।
একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ৫ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামীর কালারপুল এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালায় সাজ্জাদ। গত ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার অদুরপাড়া এলাকায় মাইক্রোবাসে এসে দিবালোকে গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসীন (২৬) নামে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করে সাজ্জাদ আবারও আলোচনায় আসে।
গত ৫ ডিসেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্যসহ চারজন আহত হন।
পুলিশের ওপর হুমকি ও লাইভে আসা
২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি ফেসবুক লাইভে এসে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমানকে ‘পেটানোর’ হুমকি দিয়ে আলোচনায় আসে ছোট সাজ্জাদ।
এসময় সাজ্জাদ বলেন, “ওসি আরিফ দেশের যেখানেই থাকুক না কেন, তাকে আমি ধরে ন্যাংটা করে পেটাব। ওসি আরিফ থানায় দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সে আমার সন্তানকে হত্যা করেছে। আমার স্ত্রীকে আটক করে জেলে নিয়ে গেছে।”
“তাকে আমি ছাড়ব না। পুলিশ না হলে তাকে আমি অনেক আগেই মারধর করতাম। পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধা করি বলেই চুপ করে আছি।”
এ ঘটনায় ওসি থানায় জিডি করেন। গত ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারে মরিয়া হয়ে ওঠে নগর পুলিশ।
সাজ্জাদ কাছে আধুনিক অস্ত্র
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭ থেকে শুরু করে টরাস নাইন এমএম পিস্তল আছে সাজ্জাদ হোসেনের কাছে।
নিজে সেই অস্ত্রের ছবি দেখেছেন দাবি করে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ জানান, সাজ্জাদের কাছে অত্যাধনিক অস্ত্র আছে। একে-৪৭ থেকে শুরু করে আধুনকি টরাস নাইন এমএম পিস্তলসহ বহু অস্ত্র-গুলি আছে তার কাছে।
শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ রাউজান, রাঙ্গুনিয়ার গহিন এলাকায় অবস্থান করতেন। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান করাটা ছিল অনেক দুরূহ। মাঝে দুই-একবার শহরে এলেও অল্প সময়ের মধ্যেই চলে যেতেন। যদিও তাকে প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখার দাবি করেছে পুলিশ।
চট্টগ্রামে সাজ্জাদকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হয়েছিল জানিয়ে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “সে দুর্ধর্ষ প্রকৃতির সন্ত্রাসী। তাকে যখন ধরতে যাওয়া হয়েছিল, সে গুলি ছুড়ে পাঁচতলা একটি ভবন থেকে আরেকটি ভবনে পালিয়ে চলে যায়। এসময় দুজন লোক আহত হয়েছিল।”

যেভাবে গ্রেপ্তার সাজ্জাদ
ছোট সাজ্জাদকে ধরার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা তথ্যের সমন্বয় চলছিল। পাশাপাশি তাকে ধরার জন্য চট্টগ্রাম পুলিশের একটি দল কয়েকদিন ধরে ঢাকায় অবস্থান করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার রাতে সাজ্জাদকে ঢাকার বসুন্ধরা সিটি শপিংমল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “সে দুর্ধর্ষ প্রকৃতির সন্ত্রাসী। তাকে যখন ধরতে যাওয়া হয়েছিল, সে গুলি ছুড়ে পাঁচতলা একটি ভবন থেকে আরেকটি ভবনে পালিয়ে চলে যায়। এসময় দুজন লোক আহত হয়েছিল।”
শনিবার সাজ্জাদ বসুন্ধরা শপিংমলে গিয়েছিল। খবর পেয়ে ঢাকায় অবস্থান করা সিএমপির সাদা পোশাকের একটি দল সেখানে যায়।
“এসময় সে পালানোর চেষ্টা করে। তখন পুলিশ আশপাশের লোকজনের সহায়তা নেয়। পরে তেজগাঁও থানা পুলিশের সহায়তায় সাজ্জাদকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।”
এদিকে শনিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে সাজ্জাদকে ছেড়া শার্টে দেখা গেছে।
সাজ্জাদ পালানোর চেষ্টা করায় পুলিশের সাথে ধস্তাধস্তিতে তার শার্ট ছিড়ে যেতে পারে বলে ধারণা কমিশনার হাসিব আজিজের।
৭ দিনের পুলিশ হেফাজতে সাজ্জাদ
সাজ্জাদের বিরুদ্ধে জোড়া খুনসহ ১৫টি মামলার তথ্য দিয়েছে পলিশ। সব মামলায় তাকে রিমান্ডে নিতে চায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
প্রথম ধাপে চান্দগাঁও থানায় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা মামলায় সাজ্জাদকে সাত দিনের হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।
রোববার চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বক্কর সিদ্দিকের আদালত সাজ্জাদের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত বছরের ২১ অক্টোবর বিকালে চান্দগাঁও থানার অদূরপাড়া এলাকায় দোকানে বসে চা পানের সময় তাহসিন নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে কালো রঙের একটি গাড়িতে করে আসা লোকজন।
ওই ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় তাহসিনের বাবার করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে।

সন্ত্রাসী সাজ্জাদের স্ত্রী দাম্ভিকতা
সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেনকে গ্রেপ্তারের পর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তার স্ত্রী তামান্না শারমিনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভিডিও বার্তা দিয়েছেন। যা রীতিম ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিওতে তামান্না শারমিনর বলেন, “আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি, বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছেড়ে আমার জামাইকে (স্বামী) নিয়ে আসব। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না।”
ভিডিওতে ১৭ মামলার আসামি সাজ্জাদ হোসেনকে ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে জামিনে ছাড়িয়ে আনবেন বলে জানান স্ত্রী তামান্না শারমিন।
তিনি বলেন, “আমার জামাই গতকাল (শনিবার) রাতে গ্রেপ্তার হয়েছে, এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। মামলা যখন আছে, গ্রেপ্তার হবেই। আপনারা যাঁরা ভাবতেছেন, আর কোনো দিন বের হবে না, তাঁদের জন্য এক বালতি সমবেদনা।’ প্রতিপক্ষকে হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, ‘এত দিন আমরা পলাতক ছিলাম, এখন তোমাদের পলাতক থাকার পালা শুরু। খেলা শুরু হবে এখন।”
সাজ্জাদের রাজনৈতিক পরিচয়
দুই যুগ আগে চট্টগ্রাম শাহ আমানত সেতুর সংযোগ সড়কে দিনের বেলায় আড়াআড়ি বাস রেখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীবাহী মাইক্রোবাস আটকে গুলি চালিয়ে আটজনকে হত্যা করা হয়। চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার আসামি ছিলেন সাজ্জাদ আলী ‘বড় সাজ্জাদ’। এই বড় সাজ্জাদ ছিলেন ‘শিবির ক্যাডার’। তারই অনুসারি হিসেবে এলাকায় পরিচিত এই ছোট সাজ্জাদ। সেও ‘শিবির ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাটহাজারী এলকার কয়েক জন ব্যক্তি জানানা, বড় সাজ্জাদের মতো ছোট সাজ্জাদও শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জামায়াতের চট্টগ্রামের নেতাদের সঙ্গে তার ওঠাবসা ছিল।
তবে চট্টগ্রাম পুলিশ তাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করার পর থেকে প্রকাশ্যে জামায়াত নেতাদের সঙ্গে আর দেখা যায়নি বলেও জানান তারা।
এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “সন্ত্রাসীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় আমরা দেখিনা। সে সন্ত্রাসী অপরাধী। পুলিশের রেকর্ডে তাই আছে।”