পৃথিবীর মানচিত্রে ভেনিস যতোটাই ছোট, সৌন্দর্য আর পর্যটক আকর্ষণে যেন ততোটাই ‘বিশেষ’। জলঘেরা একটি দ্বীপপুঞ্জ কতোটা গোছানো হতে পারে, কতোটা ‘আকর্ষণীয়’ হতে পারে প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কতোটা পর্যটক ‘ফ্রেন্ডলি’ হতে পারে তা এই শহরে না এলে হয়তো অজানাই থেকে যেতো। আমি যে শহরে থাকি, মানে ফিনল্যান্ডের উত্তরের জনপদ অউলু বা ওলু শহর থেকে ট্রেন আর প্লেনের পথ হিসেবে ভেনিসের দুরত্ব কম করে হলেও নয় ঘণ্টা। অ্যারোপ্লেনে অবশ্য আরও তিন ঘণ্টা সময় কম লাগে, ছয় ঘণ্টা। এসেছি দুই দিন হলো। আমি গল্পপ্রিয় মানুষ। গল্প হয়েছে বহু মানুষের সঙ্গে। শুনেছি তাদের কথা, তাদের আয়োজন আর আমোদ-ব্যর্থতার কথা। আজকের এই লেখায় ছাপ থেকে যাবে সেসব গল্পেরই ক্রিয়দংশ। সেইসঙ্গে যারা এই শহরে ঘুরতে আসতে চান তাদের জন্য কিছু ‘মাসালা’ দেওয়ার চেষ্টা তো থাকবেই।
ভেনিস মূলত শতাধিক দ্বীপের সাজানো এক ভূমি। কিছু কিছু দ্বীপ এতোটাই কাছাকাছি যে ছোট ছোট ক্যানেল দিয়ে বেশ পরিকল্পিতভাবে কানেক্টেড। দূরের দ্বীপের মধ্যে বুরানো সবচেয়ে দূরের। পিয়াজালে রোমা থেকে জলপথে দুরত্ব এগারো বারো কিলোমিটার। অন্যটি মুরানো ও টরসেল্লো দ্বীপ। পর্যটকরা সাধারণ এসব দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না। যদিও বেশ সময় লাগে। সেখানে কি আছে কি নেই তা গুগলে সার্চ করলেই পেয়ে যাওয়ার কথা। তাই ওসব লিখে লেখাটাকে ভারি করতে চাই না।
পিয়াজালে রোমা থেকে জলপথে প্রতিটি গন্তব্যই আকর্ষণীয়। দুপাশে প্রাচীন যুগের সুরম্য অট্টালিকা, জনপথ, বিপণীবিতান, রেস্তোরাঁ। তার মাঝ বরাবর ছুটে চলছে নানা ধরনের নৌযান। চোখ জুড়িয়ে দেওয়া সেসব দৃশ্য বোধকরি বহুদিন স্মৃতির পাতায় লেপ্টে থাকবে। যেমনটা হয়েছে আমাদের ক্ষেত্রে। রিয়ালতো ব্রিজটাকে দূর থেকে দেখে মন হচ্ছিল একটা ডিঙি নৌকা উল্টো করে বাসিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্যানেল গ্রান্ডের বুকচিড়ে। কী যে অদ্ভুত দৃশ্য। হাজারো মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে।
ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন আমাদের আমাদের গন্তব্য ছিল সান মারকো ও লিডো ডি ইয়েসোলো। আমরা শুরু করি পিয়াজালে রোমা থেকে, যাকে বলা চলে ভেনিস দ্বীপপুঞ্জের ‘শুরু’। মূলত এটিই ভেনিসের জংসন। বাস, জলযান বা ট্রেন, সব পথের সংযোগ এই স্কয়ারে। এখান থেকে পায়ে হাঁটা সেঁতু ‘পন্তে ডেল্লা কস্তিতুজিওনে’ পেরোলে সান্টা লুসিয়া রেলওয়ে স্টেশন। সান মারকো সত্যিই মনোমুগ্ধকর স্থাপত্যের নিদর্শন।
ইতালিকে অনেকই ভাবেন সাশ্রয়ী দেশ। ভেনিসকে অবশ্য আমার তেমনটি মনে হয়নি। বিশেষকরে পরিবারসহ ঘুরতে এলে খরচটা হিসেব না করাই বরং ভালো। আমরা যেখানটাতে বাসা নিয়েছি সেটির নাম মারঘেরা। এয়ারবিএনবির এই বাসা থেকে পিয়াজালে রোমাতে যেতে ১২ মিনিটের মতো সময় লাগে। তাছাড়া খরচটাও তুলনামূলক কম। ৯৯৭ স্কয়ার ফিটের পুরো বাসা তিন রাতের জন্য নিতে আমাদের গুণতে হয়েছে ছয়শ’ ইউরোর মতো। পর্যটক টেক্সও এর মধ্যেই। বলে রাখি, নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতিদিনের টুরিস্ট টেক্স ৪ ইউরো মাথাপিছু। আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ই ভ্রমণেও নিজের বাসার সাচ্ছন্দটা পাওয়ার চেষ্টা করি। নিরুপায় না হলে আবাসিক হোটেলে থেকেছি এমনটা মনে পড়ে না। সব ধরনের আধুনিক সুযোগসুবিধাই থাকে এখনকার ‘হোস্ট’ মডেলে। আর আমরা যেটা খুঁজি, রান্নার ব্যবস্থা, তা তো আছেই। আমার হোস্ট এলিসকেও বেশ ভালোই মনে হয়েছে। মাক্রো পোলো অ্যায়ারপোর্ট থেকে ওকে টেক্সট পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো পথের পরিক্রমা জানিয়ে দিয়েছে। আমি অবশ্য তাকে অনুসরণ করতে পারিনি! ভিয়া বেকেরিয়াতে আমাদের ক্ষণিক নিবাসে আসতে সময় লেগেছে ১৪ থেকে ১৫ মিনিট। যদিও আমি ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এসেছিলাম। তবে আমার মনে হয়েছে যাতায়াতের জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং যুঁতসই।
আরেকটি কথা না বললেই নয়। ভেনিসে এসে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টা, ৪৮ ঘণ্টা অথবা ৭২ ঘণ্টার টিকিট কেটে নিলে যাতায়াতে আর কোনো সমস্যাই নেই। কারণ একই টিকিটে চড়া যায় বাস, ট্রাম কিংবা জলযান।
এখানে আসার তৃতীয় দিনে আমরা ঘুরে দেখেছি বুরানো, মুরানো ও টরসেল্লো দ্বীপ। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আর হাজারো মানুষের ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। পর্যটকরা বেশ আগ্রহ নিয়ে এই দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করে। এর অন্যতম কারণ হয়তো দীর্ঘ সময় জলপথে ভ্রমণ, ব্যতিক্রমী স্থাপত্য কৌশল আর নিরিবিলি অবকাশ যাপন। বুরানো দ্বীপে দেখা মিলবে স্থানীয়দের তৈরি পোশাক-পরিচ্ছেদ, জল থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো নজরকাড়া রঙ-বেরঙের ভবন। স্থানীয় মাছের বাজারও রয়েছে এখানে। নিজের চোখে না দেখলে এই দ্বীপের সৌন্দর্য বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভবই। আর মুরানো? কাঁচের তৈরি নানারকম শো’পিসসহ রঙিন আসবাবপত্রের জন্য পর্যটকদের নজর কাড়ে এই দ্বীপ।
কিভাবে যাবেন? জলযানেই যাওয়ার একমাত্র উপায়। আর পথটা সত্যিই নতুনদের জন্য বেশ জটিল মনে হতে পারে। অন্তত আমার কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছিলো। পিয়াজালে রোমা থেকে সরাসরি মুরানো বা বুরানোতে যাওয়ার কোনো জলযান নেই। ফাইভ পয়েন্ট টু (৫.২) ওয়াটারবাসে চড়ে যেতে হবে ফন্ডামেন্তে নোভে স্টপেজে। সেখান থেকে ১২ নম্বর ওয়াটারবাসে চড়লে সর্বশেষ স্টপেজই বুরানো। আর ফিরে আসার সময় ধরতে হবে ১২ নম্বর ও ৪.২ নম্বর ওয়াটারবাস। আগের মতোই ফন্ডামেন্তে নোভে স্টপেজে এসে ওয়াটারবাস পরিবর্তন করতে হবে।
তবে যেকথা না বললেই নয়, ভেনিসের দ্বীপগুলোর স্থাপনা, তৈরির কৌশল অবাক হওয়ার মতো। মনে হয়েছে কোনো শিল্পী তার তুলিতে এঁকেছেন কাল্পনীক কোনো জনপদ! আর আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি সেই প্রদর্শনী।
লেখার শুরুতে বলেছিলাম, গল্প থাকবে পথে পথে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশীদের কথা। পরের পর্বে এ বিষয়ে লিখবো অবশ্যই। শুধু এতটুকু বলে রাখি আমার প্রিয় বাংলাদেশের হাজারো লড়াকু যোদ্ধা দাঁতে দাঁত কেটে এই জনপদে টিকে আছে, টিকিয়ে রেখেছে ভেনিসের আকর্ষণ! এখানে ‘বিদেশি’ বলতে মোটাদাগে বাংলাদেশীদেরই বোঝায়। আমি তো বলবো, ভেনিস: ‘অ্যান এনক্লেইভ অব বাংলাদেশ’। পরের পর্বে তাই থাকছে সেই লড়াকুদের কথা।