কীসের ভরসায় আওয়ামী লীগ?    

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভেঙ্গে ফেলা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এরকম সকল প্রতিকৃতি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভেঙ্গে ফেলা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এরকম সকল প্রতিকৃতি।

বাংলাদেশে বর্তমানে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো যখন আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, সেই সময়ে মাঠে নেই দলটির কোনো শীর্ষ কিংবা মধ্যম সারির নেতা। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দেশে থাকা তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও।

এ অবস্থায় দেশের বাইরে অবস্থান নেওয়া নেতারা যেমন প্রত্যাশা করছেন তৃণমূ্লের নেতাকর্মীরা মাঠে নেমে আসবে, তেমনি তৃণমূলও চাইছে প্রাণ ক্ষয়ের শঙ্কা নেই এমন শীর্ষ নেতারা দেশে ফিরুক; আইনগত উপায়ে বিরোধীদের মোকাবেলা করুক।  

তবে এটি স্পষ্ট, দুই পক্ষের একটি বড় অংশ প্রহর গুণছে ভারত কী ভূমিকা নিচ্ছে সেই অপেক্ষায়।

তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশ বিষয়ক পর্যবেক্ষক, ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক অমল সরকারের বয়ানে।  

দ্য সান ২৪কে তিনি জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান নেওয়া আওয়ামী লীগের অন্তত একডজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। তাদের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে সে প্রসঙ্গে।

অমল সরকার বলেন, “বেশিরভাগ নেতাই মনে করে ভারত সরকার এমন কিছু একটা করে দেবে যাতে করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে আবার স্বাভাবিকভাবে রাজনীতিতে ফিরবে পারবে। কারও কারও ধারণা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাতে কাজ করে যাচ্ছে ভারত এবং কিছুদিনের মধ্যে সেই ফলাফলও পাওয়া যাবে।”

ফেব্রুয়ারি মাসে নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণা দিলেও সেসব কর্মসূচি পালনে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এই দল। হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে নানা ধরনের ছবি আর ভিডিও’র মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাদের অবস্থান।

অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বেশ চাঞ্চল্য ছিল, যা নিয়ে ‘চাপে’ ছিল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারও। আর সেই ‘চাপ’ থেকে তাড়াহুড়া করে ট্রাম্পের বিশ্বস্ত সহযোগী ইলন মাস্কের স্টারলিঙ্ককে ব্যবসা দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠেন মুহাম্মদ ইউনূস, আলাপ করেন ফোনে।

যদিও এ বিষয়ে স্টারলিঙ্কের সঙ্গে আলোচনা চলছে প্রায় তিন বছর ধরে, তারপরও বিষয়টি নিয়ে জোরেশোরে প্রচার চালানো হয় গণমাধ্যমে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘চাপ প্রয়োগ করে’ সংবাদ প্রকাশে বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নরেন্দ্র মোদীর ওই সফরে বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচিত বিভিন্ন বক্তব্য নিয়েও সরব ছিল আওয়ামী লীগের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। যুক্তরাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদীকে স্বাগত জানিয়ে এবং ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করতেও দেখা গেছে দলটির প্রবাসী নেতাকর্মী ও সমর্থকদের।

আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার ৫ আগস্ট থেকে ভারতে আশ্রয়ে আছেন। দলটির বহু নেতা ‘আত্মগোপন করে’ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থান করছেন।

এর মধ্যেই গত ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি। আক্রান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের বহু মন্ত্রী কিংবা সাংসদের স্থাপনা। চূর্ণবিচূর্ণ করা হয়েছে বিভিন্ন এলাকায় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল। এসব ঘটনায় গাজীপুর ছাড়া তেমন কোথাও প্রতিরোধের মুখে পড়েতে হয়নি কাউকে।

দেশে ও দেশের বাইরে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের কর্মী-সমর্থকরা প্রত্যাশা করছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত যে ভূমিকা নিয়েছে এরপর তারা একটি চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ঢাকায় আওয়ামী লীগের এমন সমাবেশের দৃশ্য চোখে পড়েনি গেল সাত মাসে।

আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ ও মধ্যম সারির নেতা, যারা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে দ্য সান ২৪। তাদের কেউই পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি।

তাদের মধ্যে একজনের বক্তব্য ছিল এরকম: “দেখুন, এটা এখন আর শুধু আওয়ামী লীগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে যে জঙ্গি গোষ্ঠী সরাসরি জড়িত তা প্রমাণিত। এর বাইরে শুধু যে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে এমনটি নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-মন্দিরে যেসব হামলা হয়েছে সেটি তো ভারতের ভালো চোখে দেখার কোনো কারণ নেই। তাদের নিজেদের স্বার্থেই তারা উদ্যোগ নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।”

অভিযোগ রয়েছে, ভারতে কিংবা বিদেশের মাটিতে অবস্থানরত নেতারা আয়েশি জীবন যাপন করছেন। কর্মীদের ঝুঁকির মুখে ফেলে ভারতে আত্মগোপনে থাকা নেতারা সেখানে কীভাবে ‘আয়েশি জীবন’ যাপন করছেন- এমন প্রশ্ন তুলেছেন দলটির তৃণমূলের কেউ কেউ।

তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের অনুযোগের প্রমাণ মেলে অমল সরকারের বক্তব্যে।

দ্য সান ২৪কে তিনি বলেন, “আপনার হয়তো জানা আছে কলকাতার সল্টলেক এলাকায় সাধারণত ধনীদের বসবাস। আওয়ামী লীগের বহু নেতা এসব এলাকায় ফ্লাট ভাড়া নিয়ে আছেন। তাদের মাসে অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হয়। তারা স্বচ্ছন্দে জীবন-যাপন করছেন এবং পরিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যোগ দিচ্ছেন।

“একটি ঘটনার উদাহরণ দিই। আমার একটি টিভির শো’র জন্য আওয়ামী লীগের এক নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শুরুর ১০ মিনিট আগে ওই আওয়ামী লীগ নেতা জানান, তার একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ আছে, সেজন্য তিনি টিভি শোতে অংশ নিতে পারছেন না,” যোগ করেন দ্য ওয়ালের নির্বাহী সম্পাদক অমল সরকার।

“এ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের আয়েশি জীবনের একটি খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়“ মন্তব্য করে তিনি বলেন, দলের এই পরিস্থিতিতে কেউ আন্তরিক হলে এতোটা স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারতো না; তারা কেবল ভারতের দিকেই তাকিয়ে আছে।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বক্তব্য-মন্তব্যে এবং রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতেও আওয়ামী লীগের ভারত নির্ভরতার বিষয়টি এখন প্রকাশিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে এ বিষয়ে বলেন, রাজনীতিতে ফেরার ক্ষেত্রে ভারতের সাহায্যের বিষয়টি তার ভাষায় ‘আওয়ামী লীগ পুরোদমে বিশ্বাস করে’।

“একদম যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা বিভিন্ন টক শো বা আলোচনায় আমরা দেখতে পাই যে তারা আশা করছে ভারত আবার তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সাহায্য করবে ফিরে আসার ক্ষেত্রে। এটা তো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বক্তব্যে খুব স্পষ্ট।”

এ ব্যাপারে দলটির যু্গ্ম সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম. বাহাউদ্দিন নাছিমের মতে, বৃহৎ গণতান্ত্রিক এবং প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত কী অবস্থান নেবে সেটার গুরুত্ব রয়েছে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক চেতনায় বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে অবশ্যই ভারত এখানে ইতিবাচক এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা বিশ্বাস করি এবং এই বিশ্বাসের সাথে বাংলাদেশের জনগণের যেমন শ্রদ্ধা আছে, ভারতের ১৪০ কোটি জনগণের সমৃদ্ধ চিন্তা আছে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।”

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েনে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশিদের জন্য পর্যটন ভিসা বন্ধ রয়েছে।

ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করেন।

ভারতের ভূমিকা নিয়ে যে প্রত্যাশা আওয়ামী লীগের- সে প্রসঙ্গে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মাইনরিটি ইস্যু নিয়ে নিশ্চই অনেক আলোচনা হয়েছিল। তো সেইজন্য হয়তো একটা ধারণা কোথাও হয়েছিল যে বাংলাদেশের সাথে ইন্ডিয়ার যে ঘনিষ্ঠতা সেইখানে হঠাৎ একটা ব্রেক হয়েছে।”

“আমার মনে হয় না কোনো সার্বভৌম দেশ কোনোভাবে যতই সে পারস্পারিকভাবে ঘনিষ্ঠ হোক অন্য কাউকে আউটসোর্স করে দেবে। যেটা একটা ধারণার কথা উঠেছিল মাঝখানে। আমরা আশা করছি ইলেকশন হবে, জিনিসটা আবার স্থিতিশীল হবে এবং নরম্যালসি চলে আসবে।”

ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার যেই আসুক তার সঙ্গে ভারত কাজ করবে।

তবে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগকে নিয়েই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হোক সেটা হয়তো দিল্লির প্রত্যাশা থাকবে বলে যোগ করেন তিনি।

শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “আমার মনে হয় না সেরকমভাবে ইন্ডিয়া পার্টিকুলারলি কখনও আওয়ামী লীগের হয়ে কথা বলবে বা বলতে চাইবে। তবে জাতি হিসেবে আমরা দেখতে চাইবো প্রতিবেশী দেশে সবসময় অবাধ, সুষ্ঠু এবং বহুদলীয় নির্বাচন হোক। সেই হিসেবে চাইবো যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগও নিশ্চয়ই পার্টিসিপেট করুক নির্বাচনে।”

আরও পড়ুন