কে এই মেদলিন, যার নামে গ্রেটা থুনবার্গদের জাহাজ

ফিলিস্তিনি জেলেনী মেদলিন কুলাব।
ফিলিস্তিনি জেলেনী মেদলিন কুলাব।

ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তটরেখায় গাজা, অথচ গাজার কারও এখন এই সাগরে মাছ শিকারের সুযোগ নেই। নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে থাকা ফিলিস্তিনিদের জন্য কাছের ভূমধ্যসাগর এখন এক দূর সমুদ্র। আর মেদলিন কুলাবের কাছে তা হারিয়ে যাওয়া জীবিকা।

মেদলিন আজ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনাম। এটি একটি ছোট জাহাজ, বলা যায় ইয়ট। পরিবেশ আন্দোলনের চেনা মুখ গ্রেটা থুনবার্গসহ একদল অধিকারকর্মী দুর্ভিক্ষের দুয়ারে থাকা গাজার জন্য ত্রাণ নিয়ে সাগরে ভাসিয়েছিলেন ইয়টটি।

মূল অভিযানে সফল হতে পারেননি তারা। ইসরোয়েলি বাহিনী তাদের ধরে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের এই দুঃসাহসী অভিযাত্রা আন্দোলিত করেছে বিশ্ববাসীর মন।

আর সেই সঙ্গে সামনে এনেছে আড়ালে থাকা ফিলিস্তিনি এক নারীকে; যার নাম মেদলিন কুলাব। তার নামেই এই ইয়টের নাম দিয়েছে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন।

কিন্তু কে এই মেদলিন, তার গুরুত্বই বা কী? তা খুঁজে বের করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

সপরিবারে ফিলিস্তিনি জেলেনী মেদলিন কুলাব।

মেদলিন একজন জেলেনী। ফিলিস্তিনে অসংখ্য জেলের মাঝে তিনি একমাত্র নারী, যিনি সাগরে যান মাছ ধরতে। সাহসী এই নারীর নামেই তাই দুঃসাহসী অভিযানের জাহাজের নাম।

তিন বছর আগে যখন আল জাজিরা প্রথম এই নারীর সন্ধান পেয়েছিল, তখন তিনি দুই সন্তানের জননী, আরেকটি আসি আসি করছিল। স্বামী কাদের বখরকে নিয়ে মোটামুটি সুখেই চলছিল তার জীবন। কাদেরও জেলে, সাগরে গিয়ে মাছ ধরে ফিরে এসে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতেন তারা। তাতে যে অর্থ পেতেন, তাতে সংসার চালাতে বেগ পেতে হত না।

তিন বছর বাদে এখন মেদলিনের বয়স যখন ৩০ বছর, তখন সেই সুখ উবে গেছে ইসরায়েলের অবরোধে। চার সন্তানকে নিয়ে  চোখে অন্ধকার দেখতে হচ্ছে তাকে।

২০১৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের শুরুতেই বিমান হামলায় বাবাকে হারান মেদলিন, তারপর শুরু হয় উদ্বাস্তু জীবন। একটি সন্তান তখন পেটে, সেই অবস্থায় ছুটতে হয়েছিল এক স্থান থেকে আরেক স্থানে।

ওই বছরের নভেম্বরে বাবা নিহত হওয়ার পর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে খান ইউনিসে পালিয়ে যান নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেদলিন। সেখান থেকে যান রাফায়, তারপর আশ্রয় নেন দেইর আল-বালাহ ও নুসেরিয়াতে।

যুদ্ধের শুরুতে আশ্রয়ের খোঁজে একটি বাড়িতে উঠেছিলেন মেদলেব, সেখানে তার পরিবারের আরও ৪০ সদস্য ঠাঁই নিয়েছিল গাদাগাদি করে। তখনই প্রসব বেদনা ওঠে মেদলিনের।

“এটা ছিল ভয়ঙ্কর, কোনো বেদনানাশক নেই, নেই কোনো চিকিৎসা সেবা। বাচ্চার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে হাসপাতাল েথকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল। উপায়ও ছিল না, কারণ আহতদের চাপ সামাল দিতে পারছিল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।”

তাই সেই বাড়িতে ফিরে মেঝেতে ঘুমাতে হয়েছিল মেদেলিনকে, নবজাতক শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে। তার ভাষ্যে, “তোষক তো দূরে থাক, একটা কম্বলও ছিল না। না আমার, না আমার সন্তানের।”

ইসরায়েলের টানা অবরোধে আহার জোগানোই যেখানে কঠিন, সেখানে সন্তানদের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাতে হয় মেদলিন ও তার স্বামীর। কারণ এর মধ্যে তাদের জীবিকার পথও বন্ধ হয়ে গেছে।

গত জানুয়ারিতে গাজায় নিজেদের বাড়িতে ফিরেছেন মেদলিন। তবে বাড়ি না বলে ধ্বংসস্তূপ বলাই বেশি খাটে। আর সময়টি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ।

“এর চেয়ে কঠিন আর কিছু হতে পারে না। এই যুদ্ধে আমরা যে শঙ্কা, ক্ষুধা আর নির্মমতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি, তার সঙ্গে কিছুরই তুলনা চলে না,” বলেন মেদলিন।

আল জাজিরার সঙ্গে এবার যখন মেদলিনের কথা হন, তখন তিনি বসেছিলেন তাদের বসবার ঘরে জীর্ণ একটি সোফায়। তার পাশে বসা ছিল তিন সন্তান, আরেকটি কোলে। তিন বছর আগে জামালকে জন্ম দেওয়ার পর আরেকটি মেয়ে হয় তার।

মেদলিন মাছ ধরেন ১৫ বছ বয়স থেকে। বাবার নৌকায় ওঠার মধ্য দিয়ে জেলে জীবনের হাতে-খড়ি। তারপর একেই পেশা হিসাবে নেন তিনি। শুধু মাছ ধরাই নয়, রান্নায় রয়েছে তার সুখ্যাতি।

আর এখন? ইসরায়েলের হামলায় তাদের নৌকা তো গেছেই, মাছ ধরার উপকরণগুলোও ধ্বংস হয়ে গেছে। আয়ের বন্দোবস্তু হারানোটা মেদলিনের জন্য বেদনার, কিন্তু তার চেয়েও বেদনার হলো জীবিকা হারানো।

মেদলিন নামে ইয়টে গ্রেটা থুনবার্গসহ অধিকারকর্মীরা।

গ্রেটাসহ ১২ জন যখন গাজাবাসীর জন্য ওষুধ, ময়দা ও শিশুখাদ্য নিয়ে ইতালির সিসিলি থেকে জাহাজ ভাসান, তখনই এর কথা শুনতে পেয়েছিলেন মেদলিন। তবে তখনই তার মনে হয়েছিল, তাদের গাজা উপকূলে ভিড়তে দেওয়া হবে না।

 কারণ ২০১০ সালে তুরস্ক থেকে এমন একটি প্রচেষ্টা গুলি চালিয়ে নস্যাৎ করে দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। তখন ৯ জনকে হত্যাাও করা হয়েছিল।

মেদলিনের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। গাজা উপকূলে ভেড়ার আগেই তাদের আটকে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী। তারপরর ফেরত পাঠানো হয়।

তারপরও এই অভিযানকে গুরুত্বপূর্ণ মানছেন মেদলিন। যারা এই দুঃসাহসী অভিযানে নেমেছেন, তাদের আত্মার আত্মীয় ভাবছেন মেদলিন।

“বিশ্বের যে নীরবতা, তা ভাঙতে ভূমিকা রাখবে এই অভিযান। বিশ্ববাসীর মনোযোগ ফেরাবে। অবরোধ উঠবে, যুদ্ধ থামবে,” আশাবাদী মেদলিন।

সেই সঙ্গে নিজের নাম এই জাহাজে জড়িয়ে যাওয়ায় গরর্বিত হওয়ার পাশাপাশি দায়িত্বশীলতাও অনুভব করছেন এই নারী।

“এই ঘটনাটি আমাকে আন্দোলিত করছে, আমার মনে আশা জোগাচ্ছে। তারা আমার নৌকাটি বোমা মেরে ধ্বংস করে দিতে পারে, কিন্তু আমার নামটি টিকে থাকবে।”

আরও পড়ুন