অফিস ছুটির পর পড়ি-মরি করে ঘরে ফেরার প্রবণতা আমাদের অনেকেরই আছে। কেউ কেউ এ নিয়ে নাক কুঁচকালেও যারা ঘরফেরতা এসব মানুষের অনেকেই বলবেন, ‘ভাই অন্তত রাতের খাবারটা পরিবারের সাথে করতে চাই’।
বিষয়টা অস্বাভাবিক তো নয়ই, বরং এই যে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, কিংবা কাছের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে এক পাতে বসে খাওয়ার ইতিহাস কিন্তু বেশ প্রাচীন। বলা যায়, ছোট ছোট দলে এক সাথে বসে খাওয়ার এই প্রচলন চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এক সাথে বসে খাওয়ার বিষয়টিকে কেন আমরা এতো গুরুত্ব দিই? কেনই বা আমাদের এই প্রবণতা এখনো সচল?
অদ্ভুত হলেও সত্যি, আমরা ভালো সময়গুলো এক সঙ্গে বসে কাটাতে চাই। যেমন বন্ধুদের সঙ্গে খাবার খাওয়া, ডিনারে যাওয়া কিংবা ছুটির দিনগুলোতে আমরা একত্র হই প্রায়ই। বিশেষ করে প্রিয়জনদের সঙ্গে একসাথে খাওয়ার বিষয়টি এতটাই স্বাভাবিক যে এটি নিয়ে বলারও কিছু নাই। এমন সব সামাজিকতা না থাকলেই বরং ওঠে অনেক কথা।
পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যাচ্ছে, খবরের কাগজে এমন শিরোনাম কখনো কখনো উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিলেও এই প্রবণতাও কিন্তু একেবারে সমসাময়িক, তা নয়। বরং এমন আশঙ্কাও প্রায় শতবছর ধরে চলে আসছে।
তবে সবার সাথে বসে খাওয়ার বিষয়টি শুধু স্বাভাবিকই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অনেক বেশি শক্তিশালীও হয়ে ওঠে। কিন্তু কেন?
এই যে কাছের মানুষদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগির চর্চা, এর নাড়ি খুঁজতে হলে ফিরতে হবে মানবজাতির উৎপত্তিরও পেছনে। জীববিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আমাদের সবচেয়ে নিকটতম পূর্বসূরি শিম্পঞ্জি ও বোনোবোসরা দলের মধ্যে খাবার ভাগাভাগি করে খায়।
তবে নিকটজনের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করা আর একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার বিষয়টি এক নয়।
সুইডেনের আপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী নিকলাস নিউম্যানের ভাষ্য, “আপনি এক সাথে না বসে এবং অন্যদের সাথে না খেয়েও খাবার বিতরণ করতে পারেন।”
তার মানে, মানুষই তাদের এই চর্চায় নানা ধরনের জটিল সামাজিকতাকে যুক্ত করেছে।
ধারণা করা হয়, খাবার ভাগাভাগির বিষয়টি শুরু হয়েছে সম্ভবত কোনো ক্যাম্প ফায়ার ঘিরে।
মানুষ বা তাদের পূর্বপুরুষরা প্রথম কখন রান্না করতে শিখেছিল তা নিশ্চিত নয়। তবে সবচেয়ে সাধারণ ধারণা হচ্ছে, মানবজাতির রান্না শেখার বিষয়টি ঘটেছিল ১৮ লাখ বছর আগে।
কিন্তু যখন কেউ শিকার বা খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ত তখনই শুধু আগুন জ্বালাত এবং রান্না করত। ফলে ধারণা করা যায়, এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে সাহায্য করার জন্য হয়ত একটি আলাদা দল থাকত।
অক্সফোর্ডের নৃতাত্ত্বিক রবিন ডানবারের মতে, অন্ধকার রাতে উজ্জ্বল আলোর উষ্ণতা ঘিরে আপনি একবার সবার সাথে বসতে পারলে পরবর্তীতে নিজেকে অনেক বেশি চনমনেভাবে আবিষ্কার করতে পারেন।
উৎপত্তি যাই হোক, অনেক বড় ধরনের সুস্থতার সঙ্গে এক সাথে বসে খাবার খাওয়ার যোগ রয়েছে।
ডানবার ২০১৭ সালে এক গবেষণার সময়ে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী লোকজনের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তারা অন্যদের সাথে কতবার খাবার খান।
দেখা গেছে, অন্যদের সাথে খাওয়া জীবনের অনেক সন্তুষ্টির সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং এতে নির্ভরযোগ্য অনেক বন্ধুও তৈরি হয়।
ডানবারের একটি পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খাবার অনেক সামাজিক প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম।
“প্রাথমিক বংশধর এবং মানুষের মধ্যে বন্ধন তৈরিতে ভূমিকা রাখা মস্তিষ্কের এন্ডোরফিন সিস্টেমকে বাড়িয়ে দেয় খাবার। কয়েকজন একসাথে জগিং করার মতো একসাথে খাওয়াও এন্ডোরফিনের প্রভাবকে একইভাবে বাড়ায়।”
একই সময়ে একই খাবার খাওয়ার মাধ্যমে একজনকে অন্যদের কাছে আরও আস্থাবান করে তোলে। দুই সাংবাদিক সিনথিয়া গ্রিবার ও নিকোলা টুইলেই তাদের ‘গ্যাস্ট্রোপড’ নামের পডকাস্টে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারেন।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল অব বিজনেসের আইলেট ফিশবাখের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তারা। তাতে তারা দেখতে পান, মানুষ এমন লোকজনকে টাকা দিত, যারা আগে কোনো সময় একই ধরনের ক্যান্ডি খেয়েছিল।
তাছাড়া একই ধরনের স্ন্যাকস খেয়েছেন এমন লোকজন অন্যদের চেয়ে দ্রুত যেকোনো আলোচনায় সন্তোষজনক সমাপ্তি টানতে সক্ষম হন।
কিন্তু একসাথে খাওয়ার বিষয়টি সরল বিষয়ও নয়, যতটা মনে করা হয়। বিশেষ করে, বড় ধরনের কোনো ভোজের আয়োজন হয়, যেখানে বিপুল পরিমাণ খাবারের আয়োজন থাকে, তখন খাবার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাও সর্বোচ্চ পর্যায়ের থাকতে হয়।
যেমন, ফসল কাটার মৌসুমের কথা ধরা যাক। সে সময় জমির মালিক সাধারণত শ্রমিকদের জন্য বিপুল খাবারের ব্যবস্থা করেন। অথবা অফিসের কোনো বড়সড় পার্টি। এসব আয়োজনে খাবারে টান পড়লেই অতিথিদের সমালোচনা শুনতে হয়। এমনকি পরিবারিক পরিমণ্ডলেও খাবার নিয়ে অনেক সময় নানা মতবিরোধ দেখা দেয়।
নিউম্যান বলছেন, “আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে অনেকেই বলবে যে, তারা বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে খাবার খাওয়ার বিষয়টি উপভোগ করেন। কিন্তু প্রিয়জনের সঙ্গে খাবার খাওয়া অনেক সময় তিক্তও হয়ে উঠতে পারে। এটি নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য দেখানোর একটি জায়গাও বটে।”
আবার ভোজের সময় কেউ যদি ক্রমাগতভাবে আপনার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে থাকে কিংবা আপনার ওজন নিয়ে কথা বলে, তাহলে তা খুব কমই সুস্থতায় কাজে লাগে।
সুইডেনের বয়স্কদের খাবারের আচরণ নিয়ে নিউম্যানের একটি গবেষণায় আরেকটি বিস্ময়কর তথ্য জানা গেছে।
“আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা একা খেতে অস্বস্তিবোধ করে কি না, তাদের উত্তর ছিল ‘না’। তারা অন্য কারো সাথে খেতে পছন্দ করে কিন্তু আমরা যতটা মনে করি, তারা এটিকে (একা খাওয়া) ততটা ক্ষতিকর মনে করে না।
নিউম্যানের ধারণা, এক্ষেত্রে তারা সম্ভবত এরই মধ্যে একাকিত্বে ভুগতে শুরু করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে একা খাবার খাওয়ার বিষয়টি কারো অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
বিবিসি অবলম্বনে