ফেন্টানিল কেন যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধের কেন্দ্রে

Fentanyl

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৪ ফেব্রুয়ারি চীনকে টার্গেট করে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এতে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করা হয়। এর ঠিক এক মাস পর ট্রাম্প ওই শুল্ক বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেন।

শুল্ক বাড়ানোর দুই দফাতেই ট্রাম্প প্রশাসন জানায়, এই শুল্ক চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার উপায়। তাদের দাবি, চীন ফেন্টানিল ও এর মূল রাসায়নিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। এই রাসায়নিক পদার্থটি যুক্তরাষ্ট্রের মাদকাসক্তি সঙ্কটের অন্যতম কারণ।

নতুন এই শুল্কের আগে থেকেই কিছু চীনা পণ্য ও খাতে শুল্ক কার্যকর ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে এসব শুল্ক চালু করেন। পরে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই ধারাবাহিকতা মেনে তা আরও বাড়ান।

নতুন শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় গত ১০ মার্চ চীন কিছু আমেরিকান কৃষিপণ্যের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চীনের কঠোর অবস্থানের জানান দিতেই বেইজিং এই শুল্ক আরোপ করে। বেইজিং কর্তৃপক্ষের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক আরোপের ফলে তাদের নিজস্ব অর্থনীতিতে বড় কোনো প্রভাব পড়বে না।

চীনা পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর কারণ

ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। এর ফলে চীন ফেন্টানিল ও এর মূল রাসায়নিক উপাদান রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হবে।

ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিষপ্রয়োগের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ও সম্প্রসারণ করছে। আদেশে দাবি করা হয়, চীন সরকার দেশটির রাসায়নিক কোম্পানিগুলোকে ফেন্টানিল ও সংশ্লিষ্ট রাসায়নিক রপ্তানিতে উৎসাহিত করছে। এসব রাসায়নিক যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ সিন্থেটিক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া আদেশে অভিযোগ করা হয়, ফেন্টানিল বিক্রির অর্থ পাচার করছে এমন আন্তর্জাতিক অপরাধী সংগঠনগুলোকে নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে চীন সরকার।

ট্রাম্প আগে থেকেই চীনের নেতাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা রোধে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার অভিযোগ করেছেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে তিনি নিজের সোশাল মিডিয়া ট্রুথ সোশালে এক পোস্টে বলেন, ২০১৮ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মাদক ব্যবসায়ীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।

ফেন্টানিল নিয়ে চীনের প্রতিক্রিয়া

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ১২ মার্চের ব্রিফিংয়ে বলেন, বেইজিং ফেন্টানিল ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত শুল্ক আরোপের বদলে চীনকে ধন্যবাদ জানানো। বাণিজ্য নিয়ে উভয় দেশের আলোচনা চালিয়ে যাওয়া দরকার। চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

ফেব্রুয়ারিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র চীনের সহযোগিতাকে উপেক্ষা করছে। চীন এ বিষয়ে ইতিবাচক কাজ করেছে।” এসময় জিয়ান নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকৃতি জানান।

এক পৃথক বিবৃতিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ফেন্টানিল সমস্যা নিরপেক্ষ ও যৌক্তিকভাবে সমাধান করা। শুল্ক বাড়িয়ে অন্য দেশকে দোষারোপ করা সঠিক নয়।

চীনের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, তারা ফেন্টানিল উৎপাদন ও বিক্রির ওপর আরও কঠোর নজরদারি চালাবে। তারা আবারও নিশ্চিত করেছে, চীন কখনো উত্তর আমেরিকায় ফেন্টানিল রপ্তানি করেনি।

ট্রাম্পের টার্গেট কেন ফেন্টানিল

ফেন্টানিল একটি শক্তিশালী সিন্থেটিক ব্যথানাশক। এটি অস্ত্রোপচার বা জটিল ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এটি কম খরচে তৈরি করা যায় এবং অবৈধভাবে বিতরণ করা সম্ভব।

অবৈধ ফেন্টানিল যুক্তরাষ্ট্রে গত এক দশকে ওভারডোজজনিত মৃত্যুর হার বাড়িয়েছে। দেশটিতে এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল সংক্রান্ত সমস্যা এতটাই প্রকট যে, দেশটিতে মাদক ওভারডোজে মৃত্যুর সংখ্যা বন্দুক বা সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চেয়েও বেশি। সম্প্রতি এই সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এর একটি কারণ হতে পারে নালোক্সোনের সহজপ্রাপ্যতা। এটি ওভারডোজের প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।

তবে পরিস্থিতি এখনও গুরুতর। অক্টোবর ২০২৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ৮৭ হাজার মানুষ ওভারডোজে মারা গেছে। এর আগের বছরে এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার।

ফেন্টানিল বাণিজ্যে চীনের ভূমিকা

২০২১ সালে ইউএস-চায়না ইকোনোমিক অ্যান্ড সিকিউরিটি রিভিউ কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, সবচেয়ে বড় রাসায়নিক শিল্পসম্পন্ন দেশ চীন এখনও যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ ফেন্টানিল ও ফেন্টানিল সম্পর্কিত রাসায়নিক পদার্থের প্রধান উৎস দেশ। তবে চীনের ভূমিকা পরিবর্তিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিইএ) জানিয়েছে, ২০১৯ সাল থেকে চীনা পাচারকারীরা প্রস্তুত ফেন্টানিল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তারা মূলত মেক্সিকান কার্টেলগুলোর কাছে ফেন্টানিল তৈরির জন্য প্রাথমিক রাসায়নিক উপাদান রপ্তানি করছে। আর কার্টেলগুলো ওই রাসায়নিক দিয়ে মাদক ট্যাবলেট তৈরি করে।

ফেন্টানিল বাণিজ্য রোধে চীনের পদক্ষেপ

২০১৮ সালে ট্রাম্প ও শি জিনপিং আর্জেন্টিনার গ্রুপ অফ ২০ সম্মেলনে সাক্ষাৎ করার পর, চীন ফেন্টানিল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা কঠোর করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দেশটির পাচার চক্র তদন্তে আরও বেশি ভূমিকা নেওয়ার অনুমতি দেয়।

ফেন্টানিল উৎপাদনকারী ল্যাবরেটরিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে বাধা দিচ্ছিল এমন একটি লুপহোল ২০১৯ সালে চীন বন্ধ করে দেয়। একই বছরে চীন তিনজন চীনা নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল পাচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ড স্থগিত করা হয় এবং অন্য দুজনকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তবে তাইওয়ান ও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিরোধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের টানাপোড়েনে সহযোগিতা স্থগিত হয়ে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মাদকবিরোধী ও আইন প্রয়োগকারী সহযোগিতা স্থগিত করেছে। তবে জো বাইডেনের সভাপতিত্বে শেষদিকে সহযোগিতা পুনঃস্থাপন হয়।

তবে সেই সহযোগিতারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে চীনা কর্মকর্তারা ফেন্টানিল ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো দণ্ডাদেশের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়নি বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এক দূতাবাস কর্মকর্তা।

যুক্তরাষ্ট্র কি চায়

যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার নিয়ম-কানুন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে, চীনা মাদক পাচারকারী ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিতে এবং প্রাথমিক রাসায়নিকের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চায়।

ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, চীন তার দেশীয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা রাখে। ট্রাম্পের আদেশে বলা হয়, চীন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা এবং আইনপ্রয়োগ কাঠামো বাস্তবায়ন করে। কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বব্যাপী অবৈধ ওপিওইড সঙ্কট রোধ করার সক্ষমতা রাখে, কিন্তু তা করতে ইচ্ছুক নয়।

আরও পড়ুন