বাংলাদেশ-পাকিস্তান নয়া সম্পর্কে নজর কেন ভারতের

Bangladesh-POK

বাংলাদেশে গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপসারণের পর একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। এর মধ্যে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম, ঢাকার সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি।

বহু বছর ধরে চলা সমস্যাযুক্ত সম্পর্কের পর গত মাসে দুই দেশ প্রথমবারের মতো সরাসরি বাণিজ্য শুরু করেছে। ঢাকা পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করেছে, তাও বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি দামে। সরাসরি ফ্লাইট ও সামরিক যোগাযোগও পুনরায় শুরু হয়েছে। সহজ করা হয়েছে ভিসার প্রক্রিয়া। পাশাপাশি মিলছে নিরাপত্তা বিষয়ে সহযোগিতার খবরও।

ভারতের দুই প্রান্তের এই দুই দেশের মধ্যে গভীর ও বেদনাদায়ক এক ইতিহাস রয়েছে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করে। ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ৩০ লাখ প্রাণক্ষয়, আর দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম হানির বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তান সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করে।

১৯৭১ সালের ঘটনাগুলোর ক্ষত গভীর হলেও, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইসলামাবাদের সঙ্গে ঢাকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই ছিল। তখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী একত্রে সরকার পরিচালনা করেছিল।

এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি দিল্লির সমর্থন পেয়ে পাকিস্তানের থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু তার সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি ভারতে চলে যান। আর এরপর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মাত্রা পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে করমর্দন করছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উভয়ের এই হাস্যোজ্জল ছবিটি কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়া এক্সে প্রকাশ করা হয়েছিল।

সাবেক বাংলাদেশি কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, “গত ১৫ বছরে পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা কঠিন ছিল। তবে এখন তা ‘দুই সাধারণ প্রতিবেশীর’ মতো করে ফিরে এসেছে।”

এই পরিবর্তনগুলো বিশেষ করে ভারত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে বিরোধপূর্ণ।

শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্ক শীতল অবস্থায় আছে। শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠানোর বাংলাদেশের দাবির প্রতিক্রিয়া জানায়নি ভারত। শেখ হাসিনা যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ঢাকা ও ইসলামাবাদ সম্পর্কের পুনরুজ্জীবন একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।

লন্ডনের কিংস কলেজের সিনিয়র ফেলো পাকিস্তানি শিক্ষাবিদ আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, “পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক একটি কৌশলগত সম্পর্ক। তারা একত্রে ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে চায়।”

পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য শুরু ছাড়াও নজিরবিহীন কিছু ঘটনাও ঘটেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বহু-পাক্ষিক ফোরামে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া উভয় দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটছে।

গত জানুয়ারিতে একটি উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশি সামরিক প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে ‘বিরল’ সফর করেছে। সেখানে তারা  পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের সঙ্গে আলোচনা করেছে। ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশি নৌবাহিনী পাকিস্তানের আয়োজনে করাচির উপকূলে একটি বহু-জাতিক সামুদ্রিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে।

ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি ২০০৩ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে বাড়তি ঘনিষ্ঠতাকে ‘ডেজা ভু’ মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং কিছু বাংলাদেশি সেনা সদস্যের সহায়তায় ভারতীয় বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এই বিষয়টি ভারত বারবার উত্থাপন করেছিল। আমরা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে প্রমাণও দিয়েছিলাম।”

তবে তখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছিল।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সীমান্ত দীর্ঘ। ফলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করা তুলনামূলক সহজ। তবে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং তাদের ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সামরিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হওয়া ভারতের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ বলে মনে করেন বীনা সিক্রি।

তিনি বলেন, “এটা শুধু সামরিক সম্পর্ক নয়। পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ এখন বাংলাদেশের ইসলামিক পার্টি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করছে। এই পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইসলামাবাদকে সমর্থন করেছিল।”

ইউনূস প্রশাসনের প্রেস অফিস ভারতীয় মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলো সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। সেখানে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের শীর্ষ গোয়েন্দা (আইএসআই) কর্মকর্তারা ঢাকা সফর করেছেন। তারা সেই প্রতিবেদনগুলোও ‘ভিত্তিহী‘ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যেখানে দাবি করা হয়েছিল পাকিস্তানি অপারেটররা বাংলাদেশে একটি ভারতীয় বিদ্রোহী গ্রুপের ক্যাম্প পুনরায় খুলতে কাজ করছে।

বাংলাদেশে আইএসআইয়ের ভবিষ্যত ভূমিকা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়ে বিবিসির প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে।

বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশি রাজনীতিবিদরা ভালো করেই জানেন, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত সম্পর্কের কারণে ঢাকা ভারত-বিরোধী অবস্থান নিতে পারবে না।

আর দিল্লির উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি কূটনীতিকরা বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার ছবি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কয়েক লাখ বাঙালি নিহত হয় এবং হাজার হাজার নারী ধর্ষিত হয়। যুদ্ধ শেষে ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি নিরাপত্তা ও সাধারণ কর্মী ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এটি ইসলামাবাদের জন্য একটি লজ্জাজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

পাকিস্তান থেকে যুদ্ধকালীন অত্যাচারের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে ইসলামাবাদের পক্ষ থেকে এখনও সাড়া মেলেনি।

সাবেক বাংলাদেশি কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, “পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধগুলোর জন্য দায় স্বীকার করতে হবে। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে বহু দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ১৯৭১ সালের আগের সময়কালের সম্পদের বিভাজনের বিষয়ও উত্থাপন করেছি।”

পাকিস্তানের সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা যেমন ইকরাম সেহগাল বলেন, “পাকিস্তানিদের ১৯৭১ সালের ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে, বাংলাদেশিদের এমন দাবিই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রধান প্রতিবন্ধক।”

তবে অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওই মেজর দাবি করেন, বাংলাদেশকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাঙালিদের হাতে উর্দুভাষী মানুষের উপর হামলার বিষয়টি সামনে আনতে হবে।

সেহগাল, যিনি বর্তমানে করাচিত বসবাস করছেন, বলেন, “আমি নিজে পূর্ব পাকিস্তানে উর্দুভাষী বিহারিদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া নৃশংসতার সাক্ষী ছিলাম।”

ঢাকা ও ইসলামাবাদের সম্পর্কের উপর ইতিহাসের ছায়া পড়লেও অর্থনীতিবিদরা বলেন, দুই দেশ প্রথমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উন্নত করার বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারে। এটি বর্তমানে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের কম, এবং অধিকাংশই পাকিস্তানের পক্ষে।

ডেলাওয়ার ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক সাবরিন বেগ বলেন, “পাকিস্তানের ২৫০ মিলিয়ন মানুষ বাংলাদেশি বাজারের জন্য একটি শক্তিশালী সুযোগ হতে পারে মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদে।”

বর্তমানে উভয় দেশেই উচ্চ শুল্ক, ভিসা ও যাত্রা সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব ব্যবসা ও রপ্তানিকারকদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে। তবে

বেগ বলেন, “দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত হলে এসব প্রতিবন্ধকতা সহজ হবে।”

এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার ঢাকায় সফরকালে কিছু সমস্যা আলোচনা হতে পারে। বছরের শেষে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তখন নতুন সরকার বিভিন্ন পররাষ্ট্রনীতি অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে পারে।

তবে যাই ঘটুক, দিল্লির জন্য ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা মনে করে, একটি স্থিতিশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য।

আরও পড়ুন