মুখোমুখি বিএনপি-এনসিপি; বেলতলায় ফেরা ইউনূস বেকায়দায়

আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলছেন মুহাম্মদ ইউনূস।
আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলছেন মুহাম্মদ ইউনূস।

৩ আগস্ট, ২০২৪; পরিস্থিতি উত্তুঙ্গ, সেই অবস্থায় বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

শোনা যায়, সেই বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের যে পরিমাণ কাঁদানো হচ্ছে, তা দেখে আইয়ুব বাচ্চুর গানের লাইন মনে পড়ছে, আরো বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে।”

দৃশ্যত সেদিনই সেনাবাহিনীর কর্মপন্থা ঠিক হয়ে গিয়েছিল; শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য যে আর নেই, তা ঢাকা, কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে মাঠের পরিস্থিতিতে বোঝা গিয়েছিল। তার দুদিন পরেই পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।

অভ্যুত্থানে বিজয়ের তিন দিন পর অভ্যুত্থানকারী তরুণ নেতাদের আমন্ত্রণে প্যারিস থেকে উড়ে আসেন মুহাম্মদ ইউনূস, যাকে তার আগে প্রায় এক দশক ধরে দৌড়ের ওপর রেখেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।

অভ্যুত্থানের তরুণরা ইউনূসকে অভ্যর্থনা জানাতে ৮ আগস্ট উপস্থিত হয়েছিলেন শাহজালাল বিমানবন্দরে। ঢাকায় নেমেই তাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ইউনূস বলেছিলেন, “আজ আমাদের জন্য একটি গৌরবময় দিন। তারা (ছাত্ররা) এই দেশকে রক্ষা করেছে এবং পুনর্জন্ম দিয়েছে। এখন আমাদের ব্রত হল নতুন বাংলাদেশকে দ্রুত এগিয়ে নেয়া।”

“এখন আমাদের বীজতলা তৈরি করতে হবে এবং আবার জেগে উঠতে হবে। তারা (তরুণরা) বীজতলা তৈরি করবে। আমরা তাদের দিকে তাকিয়ে দেখব এবং তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী এগিয়ে যাব,” সেদিন একথা বলার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বলেছিলেন, ছাত্ররাই এই সরকারের নিয়োগকর্তা।

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট প্যারিস থেকে ফিরে শাহজালাল বিমানবন্দরে মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি।

সেদিন অভ্যুত্থানের পক্ষের সবাই এক হয়েছিল; কিন্তু যতই দিন গড়ায় তাদের দূরত্ব ততই বাড়তে থাকে। এখন তো অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরা আর বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে।

অভ্যুত্থানের দুই নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমকে অভ্যুত্থানের সরকার থেকে বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছে বিএনপি; বলেছে, অভ্যুত্থানকারী তরুণরা নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি গঠনের পর তার প্রতি এই দুজনের পক্ষপাত সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

মিয়ানমারের রাখাইনে মানবিক সহায়তার পাঠাতে কক্সবাজার দিয়ে করিডোর প্রতিষ্ঠার পক্ষে এগিয়ে যেতে চাওয়া জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকেও বরখাস্ত করার দাবি তুলেছে বিএনপি।

এই তিনজনকে বিদায়ের পাশাপাশি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে তার রোডম্যাপ প্রকাশ না হলে অন্তরবর্তী সরকারকে আর কোনও সহযোগিতা করা হবে না, তা সাফ জানিয়ে দিয়েছে খালেদা জিয়ার দল।

এর মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারও চাপ থেকে বেরিয়ে এসে হাঁক ছেড়েছেন; মিয়ানমার করিডোর কিংবা বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচিত সরকার। আর ডিসেম্বরের মধ্যে সেই সরকার আসা দরকার।

অন্য দিকে এনসিপি বুধবার নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করে তিনজন উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও আসিফ নজরুলকে ‘বিএনপির লোক’ আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগের দাবি তোলে।

এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেইসবুকে লেখেন, “এনসিপিকে নির্বাচনবিরোধী আখ্যা দিয়ে সচেতনভাবেই এক ধরনের কলঙ্ক দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি, ছাত্র উপদেষ্টারা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকতে চায়—এমন গুজব ছড়িয়ে নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করার নানা কার্যক্রমও চলমান। এই চক্রান্ত কয়েকটি দিক থেকে পরিচালিত হচ্ছে।

“দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা এবং ইন্টারিম সরকারের অংশ হওয়া দুইজন ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাওয়া মোটেই স্বাভাবিক কোনো বিষয় বলে মনে করি না।”

অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস।

এই পরিস্থিতিতে সঙ্কটে পড়েছেন ইউনূস। কারণ সব কিছুতে তিনি বরাবরই মাঝামাঝি অবস্থানে চলতে চাইছিলেন। দুই পক্ষের মাঝে থেকে তিনি নির্বাচনের সময় বলে আসছেন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে; আওয়ামী লীগের বিষয়েও মাঝামাঝি অবস্থানে ছিলেন তিনি, যদিও পরে এনসিপির চাপে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন।

তবে এখন বিএনপি ও এনসিপির মুখোমুখি অবস্থান বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে তাকে; তিনি পদত্যাগের কথা ভাবছেন বলেও জানা যাচ্ছে।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে রাজনৈতিক দল গঠন করতে নেমেছিলেন নোবেলজয়ী ইউনূস; দলের নাম ঠিক হয়েছিল নাগরিক শক্তি। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, রাজনীতি অতটা সহজ নয়।

পরে এক সাক্ষাৎকারে তাকে পুনরায় রাজনীতিতে ফেরার সম্ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনূস পাল্টা বলেছিলেন, ন্যাড়া কবার বেলতলায় যায়? কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে যখন দণ্ড নিয়ে কারাগারে যাওয়ার পথে হাঁটতে হচ্ছিল তাকে, তখন গত বছর সেই সরকারের পতনের পর সেই বেলতলায় গেলেন তিনি। এখন তার চাপও নিতে হচ্ছে তাকে।

বিষয় এক, ভাষ্য দুই

বিএনপি বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দুই উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়া এবং নির্বাচন ডিসেম্বরে না হলে সরকারকে সহযোগিতা করা হবে না বলে জানানোর পরপরই প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করতে যান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম. যিনি নতুন দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত উপদেষ্টা ছিলেন।

এই বৈঠক নিয়ে দৈনিক মানবজমিনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “প্রফেসর ইউনূস ইতোমধ্যেই অভ্যুত্থানের নায়কদের ডেকে বলেছেন, তোমরা সংযত হও, নাহলে আমি পদত্যাগ করব।”

কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে মতানৈক্য, বিএনপির হুমকির প্রেক্ষাপটে ইউনূসের সামনে বিকল্প এখন খুবই কম উল্লেখ করে মানবজমিনের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার নেতৃত্ব অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে।

“বলাবলি হচ্ছে, হয় তিনি সবকিছু মেনে নিয়ে দায়িত্বে থাকবেন। নতুবা ছেড়ে দিয়ে তার আগের জীবনে ফিরে যাবেন। অতীত ইতিহাস বলে, তিনি হঠাৎ করেই কেবলা বদল করতে পারেন। এর আগেও তিনি একদফা দল গঠন করে আবার নিজেই দলের বিলুপ্তি ঘোষণা দিয়ে রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তার পক্ষে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়াই সম্ভব।”

আকস্মিক এই বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে কিছু বলা হলেও নাহিদ বেরিয়ে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ইউনূস পদত্যাগের বিষয়টি বিবেচনা করছেন ঠিকই, তবে তা চলমান পরিস্থিতির কারণে।

বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ফাইল ছবি।

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারবেন না বলে আশঙ্কা থেকেই তিনি এমনটা ভাবছেন বলে নাহিদ জানান।

তিনি বলেন, “স্যার বলছেন- আমি যদি কাজ করতে না পারি… যে জায়গা থেকে তোমরা আমাকে আনছিলা একটা গণঅভ্যুত্থানের পর। দেশের পরিবর্তন, সংস্কার…..। কিন্তু যেই পরিস্থিতি যেভাবে আন্দোলন বা যেভাবে আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে। আমি তো এভাবে কাজ করতে পারব না। তো রাজনৈতিক দলগুলা তোমরা সবাই একটা জায়গায়, কমন জায়গায় না পৌঁছাতে পার।”

এক্ষেত্রে বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে নাহিদ বলেন, “এখন যদি রাজনৈতিক দল তার পদত্যাগ চায়…. সেই আস্থার জায়গা, আশ্বাসের জায়গা না পাইলে উনি থাকবেন কেন?”

এর মধ্যে নাহিদের আন্দোলনের সঙ্গী ও বর্তমানে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেইসবুকে লিখেছেন, “BAL, North & Delhi জোটভুক্ত হয়ে যে কুমির ডেকে আনছেন তা আপনাদেরকেই খাবে।”

অভ্যুত্থানকারীরা দৃশ্যত বোঝাতে চাইছেন, এই সময়ে ইউনূস চলে গেলে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হবে, কেননা তার বিকল্প কেউ নেই।

ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পরপরই বলেছিলেন, তিনি এই পদের জন্য অন্য কাউকে খুঁজে নিতে বলেছিলেন অভ্যুত্থানকারীদের। কিন্তু তারা বিকল্প না পাওয়ায় তিনি রাজি হন।

বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবি তুললে সম্প্রতি আবার একদল ইউনূসকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার একটি প্রচার শুরু করে।

এখন নাহিদের মাধ্যমে আসা ইউনূসের পদত্যাগের অভিপ্রায়ের খবরকে অনেকে ‘নাটক’ বলছেন। আবার ‘শেখ হাসিনার বিকল্প কে?’- আওয়ামী লীগ নেতাদের সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ।

তারা বলছেন, অভ্যুত্থানের সময় ওই কথার জবাব দেওয়া হয়েছিল এভাবে- ‘বিকল্প আমরা সবাই’। এখন ইউনূসের বিকল্প নেই বলা হচ্ছে কেন? বিকল্প হিসেবে সবাই তো আছেই!

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

উত্তপ্ত রাজনীতির মঞ্চে নির্বাচন নিয়ে অনড় বার্তা সেনাপ্রধান ওয়াকারের

সেনাপ্রধানের কড়া বার্তার পর খলিল বললেন, করিডোর হচ্ছে না

ইউনূসকে অস্ট্রেলিয়ার ৪১ এমপি-সিনেটরের চিঠি: সুর্নির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ

এবার ‘ট্যাগ’ লাগছে উপদেষ্টাদের গায়ে

নাটাই কি জেনারেল ওয়াকারের হাতছাড়া?

জেনারেল ওয়াকার কি তবে এবার নাটাই হাতে নিলেন

ইউনূস-ওয়াকার টক্করে, জসিম বিপাকে করিডোরে

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads