পরমাণু যুদ্ধ কীভাবে শুরু হতে পারে

প্রতীকী ছবি। এআইয়ের সাহায্য নিয়ে তৈরি।
প্রতীকী ছবি। এআইয়ের সাহায্য নিয়ে তৈরি।

পরমাণু যুদ্ধ শুরু হলে, তা হঠাৎ করেই এবং দুর্ঘটনাবশত শুরু হতে পারে।

বিশ্বের সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত কোনও একটি দেশের ইচ্ছাকৃত পদক্ষেপের চেয়ে ভুল বোঝাবুঝি বা মানবীয় ভুল থেকেই নেওয়া হতে পারে। একটি ভুল কম্পিউটার সিস্টেম ভুলভাবে শত্রু দেশের ক্ষেপণাস্ত্র আসছে বলে সিগন্যাল দিতে পারে। আর এর ফলে আক্রান্ত দেশ পাল্টা আক্রমণ করতে পারে। 

পরমাণু অস্ত্রঘাঁটির আশপাশে সন্দেহজনক তৎপরতা থাকলে সাধারণ যুদ্ধ পরমাণু যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা যারা নিয়মিত পরমাণু অস্ত্র পরিচালনা করেন, তারাও ভুলবশত ভুল বাহনে এই অস্ত্র উঠিয়ে ফেলতে পারেন। এরকম যেকোনো একটি ঘটনা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে।

শুধু অ্যাকশন চলচ্চিত্রের কাহিনীতেই এমন ঘটনা ঘটে না। বাস্তবেও এসব ঘটনা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে। মানুষ ভুল করে। তাই যতদিন এই অস্ত্রগুলো থাকবে, ততদিন পরমাণু দুর্ঘটনা ও এ সংক্রান্ত বিপদের ঝুঁকি থেকেই যাবে।

বর্তমানে বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে পরমাণু অস্ত্র আছে। এসব দেশ সাধারণত শান্তিকালে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও সাবমেরিনের মাধ্যমে এই অস্ত্র মোতায়েন করে রাখে। এই অস্ত্রগুলো কার্যকর রাখতে হলে সব সময় প্রস্তুত রাখা হয়। বর্তমানে ২ হাজারের বেশি পরমাণু অস্ত্র সর্বদা প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে, স্বল্প সময়ে ব্যবহারের জন্য। তাই দুর্ঘটনা ও ভুল হতেই থাকবে এবং এর ফলাফল হবে অপ্রত্যাশিত।

শীতল যুদ্ধের সময় উত্তেজনা তুঙ্গে থাকলেও পরমাণু যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু সেই সময়ের মতো প্রস্তুত থাকার কারণে বহুবার বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তখন মানবীয় ভুল ছিল একটি স্থায়ী ঝুঁকি। এখন পরমাণু যুগে আরও বেশি দেশ, আরও দ্রুত ও জটিল প্রযুক্তি এবং আরও বেশি সংঘর্ষের ক্ষেত্র থাকার ফলে সেই ঝুঁকি আরও বেড়েছে।

কীভাবে ঘটতে পারে এই বিপর্যয়, তা বুঝতে অতীতের কিছু ঘটনার দিকে তাকানো জরুরি। এসব ঘটনা দেখায়, কীভাবে বিপদ একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছিল।

অন্ধকারে খেলা

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের একটি ব্যালিস্টিক-মিসাইল সাবমেরিন ‘লী ট্রিয়ম্ফ্যান্ট’ আটলান্টিক মহাসাগরে নিয়মিত টহলে ছিল। সাবমেরিনটি পরমাণু অস্ত্র বহন করছিল। তখন ব্রিটেনের একটি সাবমেরিন ‘এইচএমএস ভ্যানগার্ড’ কাছাকাছি এলাকায় টহল দিচ্ছিল। এটিও পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। 

ফরাসি সাবমেরিন জানতো না, কাছেই ব্রিটিশ সাবমেরিন অবস্থান করছে। বিশাল ৪০ মিলিয়ন বর্গমাইলের মহাসাগরের মাঝেও দুই সাবমেরিনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।

ওই দুর্ঘটনায় কোনও একটি বা উভয় সাবমেরিন ডুবে গেলে প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা সহজ হতো না। আর এ ধরনের ঘটনা কোনও আন্তর্জাতিক সঙ্কট বা উত্তেজনার সময় ঘটত, যেমন রাশিয়া বা চীনের সঙ্গে, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেতে পারত।

উন্নত প্রযুক্তির কারণে সাবমেরিনগুলো অত্যন্ত নীরবভাবে বিশাল মহাসাগরে চলাচল করতে পারে। এগুলোর জন্য বিশেষ প্রপালশন সিস্টেম ব্যবহার করা হয়, যা শব্দ খুব কম করে। পাশাপাশি সাবমেরিনের গায়ে এমন এক ধরণের অ্যাকুস্টিক টাইল বসানো থাকে, যা সোনার তরঙ্গ শোষণ করে নেয় এবং এর প্রতিফলন কমিয়ে দেয়। এর ফলে সাবমেরিনকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “এই সাবমেরিনগুলো চিংড়ির চেয়েও কম শব্দ করে।”

এই কারণে সাবমেরিনকে সবচেয়ে নিরাপদ পরমাণু অস্ত্র হিসেবে ধরা হয়। এসব দেশের বিশ্বাস, তাদের সাবমেরিন সব সময় প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু যদি হঠাৎ কোনও একটি হারিয়ে যায়? সেনা কর্মকর্তারা জানেন, যুদ্ধ শুরু হলে প্রথমেই শত্রুপক্ষ এসব সাবমেরিনকে টার্গেট করতে পারে। যদি কোনও দেশ ভাবে, তার সাবমেরিন আক্রমণের শিকার হয়েছে, তাহলে তারা পাল্টা আঘাত হানতে পারে।

সৌভাগ্যবশত ২০০৯ সালের সংঘর্ষে দুই সাবমেরিনই ধীরে চলছিল। কোনও নাবিক আহত হননি। পারমাণবিক চুল্লি ও অস্ত্রেও কোনও ক্ষতি হয়নি। প্রথমে ফরাসি নৌবাহিনী জানিয়েছিল, তাদের জাহাজ সম্ভবত কোনও কনটেইনার শিপের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। যদিও কোনো দেশই এই ঘটনায় খোলাখুলি কিছু বলতে চায়নি। তবু দুটি সাবমেরিনেই দৃশ্যমান ক্ষতি হয়েছিল। তারপরও উভয় সাবমেরিন নিরাপদে নিজ নিজ ঘাঁটিতে ফিরে যেতে পেরেছিল।

স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্ট সদস্য অ্যাঙ্গাস রবার্টসন এই ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, “প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যাখ্যা দিতে হবে, কীভাবে এক মহাসাগরের মাঝে দুটি পরমাণু অস্ত্রবাহী সাবমেরিন একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে।”

ভাবতে পারেন, এটি ৪০ মিলিয়ন বর্গমাইলে একবারই ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা। কিন্তু বাস্তবে এটি পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে প্রথম ও একমাত্র সাবমেরিন সংঘর্ষ নয়। এমন ঘটনা অতীতেও ঘটেছে।

১৯৯৩ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক সাবমেরিন “ইউএসএস গ্যারিলিং” রাশিয়ার কোলা পেনিনসুলার কাছে অভিযান পরিচালনার সময় “নভোমস্কোভস্ক” নামের একটি রুশ ডেল্টা ফোর শ্রেণির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিনে আঘাত হানে। ওই রুশ সাবমেরিনটি ১৬টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম ছিল, যার মাধ্যমে আনুমানিক ৬৪টি পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করা যেত। 

সংঘর্ষের ফলে সাবমেরিনটির বাইরের আবরণে বড়সড় একটি ভাঁজ পড়ে। এর এক বছর আগেও এমনই একটি ঘটনা ঘটে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি লস অ্যাঞ্জেলেস শ্রেণির সাবমেরিন রাশিয়ার সিয়েরা শ্রেণির আক্রমণাত্মক সাবমেরিনের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ঘটনাটি মুরমানস্ক নৌঘাঁটি থেকে প্রায় ১৪ মাইল দূরে ঘটেছিল।

এই ধরনের সংঘর্ষের কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণাত্মক সাবমেরিনগুলো নিয়মিত, এমনকি এখনও দিনরাত রাশিয়ার কৌশলগত সাবমেরিনগুলো খুঁজে বের করা ও নজরদারি করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে রাশিয়ার সাবমেরিনগুলোও আমেরিকান, ব্রিটিশ এবং ফরাসি সাবমেরিনের ওপর একই নজরদারি চালায়।

এই রকম কোনও দুর্ঘটনা কোনও আন্তর্জাতিক সঙ্কট চলাকালীন অথবা সাধারণ যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে ঘটলে একটি ব্যালিস্টিক মিসাইলবাহী সাবমেরিন দুর্ঘটনাবশত ডুবে যাওয়ার ঘটনাই পারমাণবিক প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারত। তবে এই দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে, উভয় পক্ষই খুব দ্রুত বুঝে যায় কী ঘটেছে এবং সঙ্কট এড়ানো সম্ভব হয়।

কিন্তু এমন সংঘর্ষ ২০২২ সালের অক্টোবরে, রাশিয়া ইউক্রেনে পারমাণবিক হামলা চালাতে পারে, এমন সময়ে ঘটলে কি হতে পারত।

ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা

পারমাণবিক পরাশক্তির মধ্যেই এই ধরনের বিপদ কেবল সীমাবদ্ধ নয়। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, দক্ষিণ এশিয়াও একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক উত্তেজনার কেন্দ্র হিসেবে রয়ে গেছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গত মে মাসে সংঘর্ষ শুরু হলে শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র এই দ্বন্দ্বে জড়াতে চায়নি। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে যখন ভারতীয় ড্রোন পাকিস্তানের নূর খান বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়। ওই ঘাঁটিটি ইসলামাবাদের কাছে অবস্থিত এবং পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানস ডিভিশনের সদর দফতরের খুব কাছেই। এটি পাকিস্তানের পারমাণবিক কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা মনে করেন, এই হামলাসহ আরও কিছু ঘটনায় উত্তেজনা পারমাণবিক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে।

ভারতের তুলনায় সামরিকভাবে দুর্বল থাকার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান তার পারমাণবিক অস্ত্রকে “চূড়ান্ত প্রতিরক্ষা” হিসেবে বিবেচনা করে। তাই এই অস্ত্রগুলোর প্রতি যেকোনো হুমকিকে তারা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়।

দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধংদেহী অবস্থান ও বক্তব্য পরিস্থিতিকে খুব সহজেই প্রচলিত যুদ্ধ থেকে পারমাণবিক সঙ্কটে রূপ দিতে পারে। এই সংঘর্ষের সময় “তৃতীয় পক্ষের তৈরি প্রচুর ভুয়া তথ্য” ছড়িয়ে পড়ে, যা পরিস্থিতিকে আরও অস্পষ্ট ও বিপজ্জনক করে তোলে। উল্লেখযোগ্য যে, এই প্রথমবার নয়—ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এর আগে এমন উত্তেজনা বহুবার দেখা গেছে।

২০২২ সালের ৯ মার্চ সন্ধ্যা ৬:৪৩ মিনিটে পাকিস্তান দেখতে পায়, ভারতীয় ব্রহ্মোস ক্রুজ মিসাইল ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারতীয় অংশে উড়ছে। কয়েক মিনিট উড়ার পর হঠাৎ মিসাইলটি পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং তিন মিনিটের মধ্যে মিয়ান চান্নু শহরের কাছে একটি হোটেলের পার্কিং লটে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়।

কোনও পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই, একটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রের মিসাইল আরেক পারমাণবিক রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আঘাত হানে। কেউ বুঝতে পারে না, কেন এমন ঘটনা ঘটল।

ঘটনার পরপরই পাকিস্তান সীমান্তবর্তী ঘাঁটিগুলোতে হাই অ্যালার্ট জারি করে। অথচ ভারত পুরোপুরি চুপ থাকে। কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয় না বা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগেরও চেষ্টা করে না।

এরই মধ্যে বিধ্বস্ত মিসাইলের ছবি ও ভিডিও সোশা মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তান এক সংবাদ সম্মেলন করে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে বলে, “এই ঘটনার ব্যাখ্যা ভারতের দেওয়া উচিত।”

তবুও অনেক প্রশ্ন থেকে যায়: মিসাইলটি কীভাবে উৎক্ষেপণ হলো? এটি কি দুর্ঘটনা ছিল, নাকি ইচ্ছাকৃত?

দুই দিন পর ভারত একটি বিবৃতি দেয়। তারা জানায়, “প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে” মিসাইলটি “অসাবধানতাবশত উৎক্ষেপণ” হয়েছিল। এরপর দুই সপ্তাহ পর বিবৃতিটি সংশোধন করে জানানো হয়, এটি “মানবিক ভুলের কারণে” ঘটেছে।

অবশেষে ২০২৪ সালের মার্চে ভারতীয় আদালত প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ করে। জানা যায়, ভারতীয় বিমানবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একটি ঘাঁটি পরিদর্শনে যান। তাকে মিসাইল উৎক্ষেপণ পদ্ধতি দেখানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্রুরা মিসাইলের যুদ্ধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ভুলে যান। ফলে সেটি উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় থেকে যায়।

ভুলটি ঘটে একটি শান্তিপূর্ণ সময়কালে। সৌভাগ্যবশত কেউ হতাহত হয়নি এবং যেখানটায় মিসাইলটি পড়ে, সেটি ফাঁকা ছিল। পাকিস্তান পরে নিশ্চিত করে যে মিসাইলটি “অস্ত্রবিহীন” ছিল। যদিও কিছু বিমান খুব কাছাকাছি দিয়ে উড়ে গেলেও কোনও বিমান আঘাত পায়নি।

২০২২ সালের নভেম্বরে একটি মিসাইল পোল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে একটি শস্য সংরক্ষণ স্থাপনায় আঘাত হানে। এতে দুজন নিহত হন। ইউক্রেন সীমান্তের খুব কাছাকাছি ঘটনাটি ঘটে।

প্রথমদিকে ধারণা করা হয়, এটি রাশিয়ার হামলা। ফলে ন্যাটো দেশগুলোর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারণ এটি ন্যাটোর সদস্য একটি দেশের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু পরে জানা যায়, এটি ছিল ইউক্রেনের একটি আকাশ প্রতিরক্ষা মিসাইল।

এই কয়েক ঘণ্টার বিভ্রান্তির সময়, ওয়াশিংটন এবং ন্যাটো নেতারা ভয়ংকর কিছু ঘটার আশঙ্কা করেন। আর এই ঘটনা প্রমাণ করে—যখন পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকে, তখন এমনকি সামান্য ঘটনাও নেতাদের তড়িঘড়ি প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য করে। এমনকি যখন সব তথ্য পরিষ্কার নাও হয়।

রেড অ্যালার্ট

মানব সভ্যতার সমাপ্তি কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটে যেতে পারে — এটাই পরমাণু যুদ্ধকে অন্যান্য যেকোনো যুদ্ধের চেয়ে আলাদা করে তোলে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় উভয় পক্ষই তাদের পরমাণু অস্ত্র সর্বদা উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় রাখত। এই অবস্থাকে বলা হয় “হেয়ার ট্রিগার” বা “চুলের মতো সূক্ষ্ম স্নায়ু সংযোগে সংবেদনশীল”। এর উদ্দেশ্য ছিল, শত্রুপক্ষের আকস্মিক হামলার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা।

সে সময় “বোল্ট আউট অব দ্য ব্লু” বা হঠাৎ ও পূর্বাভাসহীন পরমাণু হামলার আশঙ্কা ছিল বাস্তব ও স্থায়ী। তখনকার নেতারা বিশ্বাস করতেন, এমন হামলা প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো মুহূর্তের মধ্যে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি রাখা।

এই ব্যবস্থার ফলে বারবার ভুল ও মিথ্যা সতর্কতা তৈরি হয়। প্রশিক্ষিত ও দক্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ভুল এক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় — যেমনটা সাধারণ জীবনের ক্ষেত্রেও হয়।

১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা চালু করে। এরপর থেকে ডিসেম্বর ১৯৭৬ পর্যন্ত — মোট ১৬ বছরের মধ্যে — এই ব্যবস্থা সাতবার পরমাণু হামলার ভুয়া সংকেত দেয়। অর্থাৎ গড়ে প্রতি দুই বছরেই একটি করে মিথ্যা সংকেত আসে।

এরপর ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে টানা পাঁচটি মিথ্যা সংকেতের ঘটনা ঘটে।

১৯৭৯ সালের ৯ নভেম্বর সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে, এনওআরএডি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে কর্তব্যরত কর্মকর্তারা হঠাৎ একটি ইলেকট্রনিক পর্দায় সোভিয়েত পরমাণু হামলার দৃশ্য দেখতে পান। ডিসপ্লেতে দেখা যাচ্ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব কাঠামোকে ধ্বংস এবং পরমাণু বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে বিশাল আকারের আক্রমণ চালানো হয়েছে। এতে দেখা যায়, ভূমি ও সমুদ্র থেকে অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে।

এই সতর্কতা প্রথম ধাপ। অর্থাৎ “মিসাইল ডিসপ্লে কনফারেন্স” পেরিয়ে যায়, যেখানে অস্বাভাবিক তথ্য যাচাই করা হয়। এরপর এটি “থ্রেট অ্যাসেসমেন্ট কনফারেন্স”-এ পৌঁছায়। তখন স্ট্র্যাটেজিক এয়ার কমান্ডের বি-৪২ বোমারু বিমানের দলকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়। মিনিটম্যান ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীকে নিন্ম-স্তরের সতর্কতায় আনা হয়। আর ‘ডুমসডে প্লেন’ বা প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত পরমাণু নির্দেশনার নিরাপদ বিমান আকাশে উড়ে যায়।

ছয় মিনিট পর সতর্কতা বাতিল করা হয়। দেখা যায়, আকাশে কোনও ক্ষেপণাস্ত্রই নেই। তদন্তে জানা যায়, কেউ একজন ভুল করে একটি প্রশিক্ষণ সিমুলেশনের টেপ এনওআরএডি’র লাইভ সতর্কতা ব্যবস্থায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

এরপর ১৯৮০ সালের ১৪ মার্চ। আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র আলাস্কা, কানাডা ও ওরেগনের দিকে ছুটে আসছে বলে সংকেত দেয়। ডুমসডে প্লেন মুহূর্তের মধ্যেই রানওয়ে ধরে চলতে শুরু করে। কিন্তু এটি আবারও একটি মিথ্যা সংকেত ছিল।

১৯৮০ সালের ২৮ মে, আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা হঠাৎ একটি বিশাল সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দেখায়। এক সিস্টেমে দেখানো হয়, ২,০২০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে। তবে এই সংকেত মাত্র ছয় সেকেন্ড স্থায়ী হয়। তাই পাল্টা কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

একই বছরের ৩ জুন রাত ২টা ২৬ মিনিটে আগাম সতর্কতা ব্যবস্থায় দেখা যায়, দুটি সোভিয়েত সাবমেরিন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সংখ্যাটি বেড়ে ২০০ হয়। ছয় মিনিট পরে একই সিস্টেম দেখায়, ২,০২০টি আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ হয়েছে — এটি আগের ২৮ মে’র ভুলের অনুরূপ। বারো মিনিট পর সিস্টেম জানায়, ২০০টি সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে।

তখন বি-৫২ বোমারু বিমানগুলোর ইঞ্জিন চালু করতে বলা হয়। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জবিগনিউ ব্রেজিনস্কির কাছে ফোন যায়। পরে তিনি স্মরণ করেন, তার সামরিক সহকারী স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “আমরা পরমাণু হামলার শিকার হয়েছি।”

পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল প্রেসিডেন্টকে ফোন করে প্রতিরোধমূলক পাল্টা আক্রমণের সুপারিশ করা।

৩২ মিনিটের ভীতিকর অপেক্ষার পর জানা যায়, আকাশে কোনও ক্ষেপণাস্ত্রই ছিল না। সতর্কতা প্রত্যাহার করা হয়। ব্রেজিনস্কি প্রেসিডেন্টকে ঘুম থেকে তোলেননি। কিন্তু তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পরে তিনি বলেন, “আমার মনে হচ্ছিল, ২৮ মিনিটের মধ্যে আমরা সবাই মারা যাব। আমার প্রেসিডেন্টকে বোঝাতে হতো, এখনই আমাদের পাল্টা আক্রমণ করতে হবে।”

তিনি ভাবছিলেন, “আমি যদি প্রেসিডেন্টকে ফোন করে বলি, ‘স্যার, আমরা আক্রমণের শিকার হয়েছি’ — আর তিনি বলেন, ‘জবিগ, তুমি দুঃস্বপ্ন দেখছো না তো? তুমি পাগল হয়েছো?’ — তখন আমি কীভাবে বোঝাবো?” প্রেসিডেন্ট ছিলেন সাবেক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও অভিজ্ঞ। তাই তাকে এমন সঙ্কটে বোঝানো সহজ কাজ ছিল না।”

মাত্র তিন দিন পর ৬ জুন ১৯৮০ সালে আবারও একই ঘটনা ঘটে। সতর্কতা সিস্টেমে ২,০০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে আসছে বলে দেখা যায়। আবারও বোমারু বিমানগুলো প্রস্তুতি নিতে শুরু করে, ইঞ্জিন চালু হয়। ১৭ মিনিট পরে সতর্কতা প্রত্যাহার করা হয়। কারণ আকাশে কোনও ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না।

১৯৮০ সালের মে ও জুন মাসের এসব ভুল সংকেতের মূল কারণ ছিল একটি কম্পিউটার চিপের ব্যর্থতা। সাধারণ অবস্থায় কম্পিউটার চিপটি ‘০-০-০’ সংকেত পাঠাত, যার অর্থ ছিল আক্রমণ নেই। কিন্তু সেই চিপ হঠাৎ করে এলোমেলোভাবে ‘২’ সংখ্যা ঢোকাতে শুরু করে, যার ফলে সিস্টেমে দেখা যায় ২০০ বা ২,০০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে।

এই ধরনের কম্পিউটার সমস্যা আরও অনেক সময় ঘটেছে। ৩০ বছর পরে ওয়াইমিংয়ের ওয়ারেন এয়ার ফোর্স বেসে ৫০টি মিনিউটম্যান থ্রি পরমাণু আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র হঠাৎ অফলাইনে চলে যায়। ক্ষেপণাস্ত্র চুরি বা হস্তক্ষেপ ঠেকানোর জন্য থাকা নিরাপত্তা অ্যালার্মগুলোর সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ব্যর্থতা এতটাই গুরুতর ছিল যে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্টকে অবহিত করা হয়।

পরে জানা যায়, এটি রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়ার কোনও সাইবার আক্রমণ ছিল না। এটি ছিল রক্ষণাবেক্ষণের সময় একটি সার্কিট কার্ড ভুলভাবে ইনস্টল করার ফল। কিন্তু ঘটনার সময় এটি কেউ জানত না। কোনও সঙ্কটকালীন সময়ে এই ঘটনা ইচ্ছাকৃত নাশকতা বলেই মনে হতো।

১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বেসামরিক কোরিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমান গুলি করে ভূপাতিত করে। বিমানটি ভুল করে সাইবেরিয়ার আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছিল। কয়েক সপ্তাহ পর সোভিয়েত আগাম সতর্কীকরণ রাডারে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ছুড়েছে।

ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সোভিয়েত নেতৃত্ব আশঙ্কা করছিল, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো প্রথমে পারমাণবিক হামলা চালাতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে একটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ খুব সহজেই সোভিয়েত পাল্টা হামলার কারণ হতে পারতো।

তবে কর্তব্যরত কর্মকর্তা কর্নেল স্তানিস্লাভ পেত্রোভ যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য আক্রমণের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি জানতেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আক্রমণ করতো, তবে তা হতো বিশাল পরিসরে। তাই তিনি একটি একক ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণকে যুক্তিহীন মনে করেছিলেন। তিনি ভাবেন, এটি সম্ভবত একটি প্রযুক্তিগত ত্রুটি। পরবর্তীতে জানা যায়, সেটি সত্যিই একটি ভুয়া সংকেত ছিল। প্রশ্ন রয়ে যায়, পেত্রোভের মতো সাহসী সিদ্ধান্ত কি অন্য সোভিয়েত কর্মকর্তারাও নিতে পারতেন?

২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সদস্যরা একটি মারাত্মক ভুল করেন। তারা অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত নিষ্ক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরিবর্তে ভুল করে ছয়টি সজীব পারমাণবিক ওয়ারহেডযুক্ত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র একটি বি-৫২ বোমারু বিমানে লোড করেন। 

বিমানটি পুরো যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দিয়ে লুইজিয়ানার বার্কসডেল এয়ার ফোর্স ঘাঁটিতে পৌঁছায়। সেখানেও একদিন ধরে বিমানটি নজরদারিহীন ছিল। পরে এক কর্মকর্তা আবিষ্কার করেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলোতে পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল। বিমানবাহিনী জানতই না, তারা ছয়টি পারমাণবিক অস্ত্র লোড করেছে, উড়িয়েছে এবং একদিনের জন্য সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল।

ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি। এডব ফায়ার ফ্লাই।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প টুইট করেন যে, তার পারমাণবিক বোতাম উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের চেয়ে “অনেক বড়”। এরপর কয়েক দিনের মধ্যে হাওয়াইতে হাজারো মোবাইল ফোনে একটি জরুরি সতর্কবার্তা ভেসে ওঠে: “হাওয়াইয়ের দিকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধেয়ে আসছে। দ্রুত আশ্রয় নিন। এটি কোনও মহড়া নয়।” প্রায় ৪০ মিনিট ধরে হাওয়াইয়ের বাসিন্দারা আতঙ্কে ছিলেন। পরে জানা যায়, এটি ছিল একটি ভুয়া সংকেত। গভর্নর ডেভিড ইগে ব্যাখ্যা দেন, “একজন কর্মচারী ভুল বোতাম চাপেছিলেন।” এটি আবারও প্রমাণ করে, দুর্ঘটনা সবসময় ঘটতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্রও এই বাস্তবতার বাইরে নয়।

“দেখা যায় না, কিন্তু আঘাত হানে”

স্নায়ুযুদ্ধের সময় পরাশক্তিরা পারমাণবিক এবং প্রচলিত সামরিক ক্ষমতাগুলো আলাদা রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বর্তমানে এই সীমারেখা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এখনও পারমাণবিক এবং প্রচলিত অস্ত্র আলাদা রাখে। তবে উভয় ব্যবস্থার জন্য একই কমান্ড, নিয়ন্ত্রণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে। এছাড়াও কিছু বিমান উভয় ধরনের অস্ত্র বহনে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ পারমাণবিক নির্দেশনায় সামরিক বাহিনীকে পারমাণবিক ও প্রচলিত হামলা একসঙ্গে সমন্বয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে রাশিয়া ও চীন এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে যাচ্ছে যেগুলো একই সঙ্গে পারমাণবিক ও প্রচলিত ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। এই ওয়ারহেডগুলো মুহূর্তেই পরিবর্তন করা সম্ভব।

ফলে কোনও দেশ আক্রমণের মুখে পড়লে তারা বুঝতেই পারবে না আগত ক্ষেপণাস্ত্র পারমাণবিক নাকি প্রচলিত অস্ত্র বহন করছে। প্রতিক্রিয়া জানানোর ধরনের ওপর এই বিভ্রান্তির প্রভাব হতে পারে মারাত্মক।

নতুন ধরনের হুমকি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় মহাকাশে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে রাশিয়া একটি সয়ুজ রকেট উৎক্ষেপণ করে। এতে একটি নতুন ধরনের স্যাটেলাইট ছিল। রাশিয়া দাবি করে, এই স্যাটেলাইট কেবল দেশীয় স্যাটেলাইটগুলোর “কারিগরি অবস্থা” পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে।

কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ভিন্ন। মাত্র দুই সপ্তাহের কম সময়ে স্যাটেলাইটটি হঠাৎ দুটি অংশে বিভক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল জন “জে” রেমন্ড এই ঘটনাকে বর্ণনা করেন “রাশিয়ান পুতুলের মতো”। এরপর দুই রুশ স্যাটেলাইট যুক্তরাষ্ট্রের একটি গুপ্তচর কেএইচ-১১ স্যাটেলাইটকে অনুসরণ করতে শুরু করে। এই স্যাটেলাইট যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে টাইম ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রেমন্ড বলেন, এই আচরণ “অস্বাভাবিক এবং উদ্বেগজনক” এবং মহাকাশে একটি “বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি” করতে পারে। এর আগে ২০১৭ সালে রাশিয়া এমন একটি স্যাটেলাইট পরীক্ষা করেছিল যেটি মহাকাশে একটি বস্তুকে উৎক্ষেপণ করেছিল। এই ধরনের প্রযুক্তি রাশিয়ার স্যাটেলাইট পর্যবেক্ষণ ও আক্রমণের সক্ষমতা প্রমাণ করে।

সেবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে তাদের স্যাটেলাইটের বিরুদ্ধে একটি সরাসরি হুমকির কথা স্বীকার করে। কিন্তু এটি শেষবার ছিল না। এই নীরব কিন্তু বাস্তব হুমকি হলো, একটি স্যাটেলাইট আক্রমণের শিকার হতে পারে—ফলে একটি দেশের সামরিক ‘চোখ ও কান’ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভাবে স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল—বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে। এই স্যাটেলাইটগুলোই পারমাণবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অস্ত্র নিক্ষেপের আদেশ পৌঁছাতে সহায়তা করে।

একইসঙ্গে এই স্যাটেলাইটগুলো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করার কাজও করে।

তাই কোনও প্রচলিত যুদ্ধে একটি পক্ষ শত্রুর স্যাটেলাইট ধ্বংস করে ফেললে সেটি প্রতিপক্ষের পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ভেঙে দেয়। এর ফলে প্রতিপক্ষ মনে করতে পারে, এটি একটি পারমাণবিক হামলার পূর্বাভাস—এবং সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে।

বর্তমানে অনেক স্যাটেলাইট ও মহাকাশযান একই সঙ্গে বেসামরিক ও সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। তাই একটি দেশের উদ্দেশ্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, “রেনডেভু ও প্রক্সিমিটি অপারেশনস” (র‌্যান্ডেভু এবং কাছাকাছি যাওয়া)—যেমন কৌশলগুলো স্যাটেলাইট মেরামত বা পরিচালনায় ব্যবহৃত হতে পারে, আবার অন্য দেশের স্যাটেলাইট ব্যাহত করতেও ব্যবহৃত হতে পারে।

এই ধরণের অস্পষ্টতা পরমাণু যুগে আরও জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বেসামরিক ও সামরিক প্রযুক্তির মধ্যকার সীমারেখা ধোঁয়াটে হয়ে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের বিষয় হলো, যখন কোনও অস্ত্র একই সঙ্গে পারমাণবিক ও প্রচলিত ভূমিকা পালন করতে পারে, তখন যুদ্ধের সময় এমন ভুল সিদ্ধান্ত আসতে পারে যা পুরো মানবজাতিকে বিপদের মুখে ফেলতে পারে।

যেকোনো সঙ্কটকালে প্রতিপক্ষের সঙ্গে নির্ভরযোগ্যভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে না পারলে একটি ছোট দুর্ঘটনা দ্রুত একটি বড় বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। তাই পারমাণবিক অস্ত্রধারী প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য একে অপরের সঙ্গে সঙ্কটকালীন সময়ে নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনভাবে গঠিত হওয়া উচিত যাতে তা হামলার মধ্যেও নির্ভুলভাবে কাজ করে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো স্বচ্ছতা বা পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলোর মাধ্যমে প্রতিটি দেশের সামরিক সক্ষমতা ও অভিপ্রায় সম্পর্কে একে অপরকে জানার সুযোগ তৈরি হয়। এই ধরনের চুক্তি ভবিষ্যৎ আচরণ পূর্বানুমানযোগ্য করে তোলে এবং উত্তেজনা বাড়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনে। 

আইনি বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন এবং প্রয়োগযোগ্য চুক্তিগুলো সবচেয়ে কার্যকর। তবে যাচাইকরণ ছাড়াও রাজনৈতিকভাবে সম্পাদিত অনানুষ্ঠানিক চুক্তিগুলোও ঝুঁকি হ্রাসে উপকারী হতে পারে। এছাড়া, যাচাইকৃত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি এমন তথ্য সরবরাহ করতে পারে যা গুপ্তচর বা স্যাটেলাইটের পক্ষেও জানা সম্ভব নয়।

এই বিষয়ে রাষ্ট্রনেতাদের উচিত কোনও সঙ্কট শুরু হওয়ার আগেই এগিয়ে এসে পদক্ষেপ নেওয়া। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একের পর এক এমন ঘটনা ঘটেছে যা বড় ধরনের সংঘর্ষে পরিণত হতে পারতো। তবে অনেক সময় পর্দার আড়ালে মধ্যম পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তারা পূর্ব ও পশ্চিম পক্ষের হয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং পারমাণবিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা চালাতেন।

কিন্তু বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে এমন সংযোগ কমে এসেছে এবং চীনের সঙ্গে এই যোগাযোগ খুবই দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য।

স্নায়ুযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ছিল ৩০ মিনিট বা তার কম সময়। অথচ এখনকার দিনে ক্ষেপণাস্ত্র বা পানির নিচে চালিত পারমাণবিক টর্পেডো এত দ্রুত আঘাত হানতে সক্ষম যে, ৩০ মিনিটও বিলাসিতা মনে হবে।

আরও পড়ুন