পাকিস্তানের কোনও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও সরকার প্রধানের এমন অন্তরঙ্গ বৈঠক শেষ কবে দেখা গেছে, তা যে কারও মনে করা কঠিন হবে। তা দেখা গেল কায়রোয়।
ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে মিশরের কায়রোয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে বৃহস্পতিবার বৈঠক করলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
কায়রোরে একটি হোটেলে এই বৈঠকের পর দুজনের হাতে হাত রাখা ছবি দুই সরকারের পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। শেহবাজ শরিফ আবার সেই ছবি এক্স হ্যান্ডেলে দিয়ে ইউনূসকে নিজের বন্ধু অভিহিত করেছেন।
ইউনূসও বলেছেন, একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহা করে ইসলামাবাদের সঙ্গে প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলতে চান তিনি।
গত আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নয়া দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্ক যখন খারাপের দিকে, তখন ইউনূসের পাকিস্তানমুখী তৎপরতায় তীর্যক দৃষ্টি হেনেছে ভারতের সংবাদমাধ্যম।
বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে টানাপড়েন আসার অন্যতম কারণ সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় পাওয়া। তারপর হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর তা আরও নাজুক হয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতকে পাশে পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের টানা শাসনকালে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক ছিল বেশ উষ্ণ।
তখন পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই ছিল। বরং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে সেই আনুষ্ঠানিক সম্পর্কেও চিড় ধরেছিল।
কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উল্টে গেছে পাশার দান। ভারত যখন বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা দেওয়া বন্ধ করছে, তখন পাকিস্তান ভিসা করছে সহজ। ভারতের রাজনীতিকরা যখন বাংলাদেশে পণ্য পাঠানো বন্ধের হুমকি দিচ্ছে, তখন পাকিস্তান থেকে সেই পণ্য আনতে উদ্যোগী হচ্ছে ইউনূসের সরকার।
২৩ বছর যাদের শাসন-শোষণের নিগড়ে বন্দি থাকার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যার কারণে যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল শীতল, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে সম্পর্ক উষ্ণ হয়ে ওঠার মধ্যে কায়রোয় শেহবাজের সঙ্গে বৈঠক করলেন ইউনূস। তার ঠিক আগেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এক পোস্ট নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল সরকার।
বাংলাদেশের সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস পরিবেশিত খবর অনুযায়ী, বৈঠকে ইউনূস একাত্তরের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধানের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, “বিষয়গুলো বারবার আসছে। আসুন আমরা সামনে এগিয়ে যেতে সেই বিষয়গুলোর ফয়সালা করি।”
“ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিষয়গুলো চিরতরে সুরাহা করে ফেলা ভালো হবে,” এমনটাই পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন তিনি।
১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি বাংলাদেশের কাছে, নেয়নি এখানে আটকে পড়া সেদেশের নাগরিকদেরও, যারা বিহারি নামে পরিচিত। ২৩ বছরে এই বাংলা থেকে নিয়ে যাওয়া সম্পদের মূল্যও বাংলাদেশ পায়নি।
ইউনূসের আহ্বানের জবাবে শেহবাজ যা বলেছেন, তাতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তার কোনও স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ পায়নি।
তিনি বলেছেন, “১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত বিষয়গুলো মীমাংসা করেছে। কিন্তু যদি অন্যান্য অমীমাংসিত সমস্যা থাকে, তবে সেগুলো দেখতে পেলে তিনি খুশি হবেন।”
তবে ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা যে উষ্ণতায় ভরা ছিল, তা এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন তিনি। শেহবাজ লিখেছেন, দুই দেশের ‘ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক’ বন্ধন মজবুত করার বিষয়ে তারা আলোচনা করছেন। বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানো নিয়েও তাদের কথা হয়েছে।
শেহবাজ শরিফের পোস্টের কোথাও ১৯৭১ এর কথা ছিল না।
বাসস জানিয়েছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ইউনূসকে তার সুবিধামত সময়ে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণও জানান।
ইউনূসের স্েগ শেহবাজ শরিফের বৈঠক নিয়ে পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন সংস্করণে তেমন কোনও খবর চোখে না পড়লেও ভারতের সংবাদপত্রগুলোতে তা বেশ ভালোভাবেই এসেছে।
এবিপি আনন্দের অনলাইন সংস্করণে এই খবরের শিরোনাম করেছে- “আরও কাছাকাছি পাকিস্তান-বাংলাদেশ! পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের ইউনূসের বৈঠক।”
এই প্রতিবেদনের শুরুটা হয়েছে এভাবে- “কায়রোতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করলেন মুহম্মদ ইউনূস। বিভিন্ন ইস্যুতে একে অন্যকে সহযোগিতার বার্তা দিল দুই দেশ। বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তান বানাতে চাইছেন ইউনূস।”
এরপর আবার লেখা হয়েছে- “সবশেষে মনে হয়, এটাই বাকি ছিল! চূড়ান্ত ভারত-বিদ্বেষী আবহে, মিশরের রাজধানী কায়রোতে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহম্মদ ইউনূস। একেবারে পরম বন্ধুর মতো একে-অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন। করমর্দন করলেন। তারপর হল বৈঠক।”
হিন্দুস্থান টাইমস বাংলার শিরোনাম এমন- “’আমার বন্ধু’, ইউনুসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লিখলেন পাক প্রধানমন্ত্রী, আলোচনা কী হল?”
তাদের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে- “৭১এর যুদ্ধ। খান সেনাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধারা গর্জে উঠেছিলেন। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিল ভারত। সেই পাকিস্তানের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল বাংলাদেশ। আর অতীতের সেই সংগ্রাম ভুলে এবার পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে মরিয়া ইউনুসের বাংলাদেশ।
“একদিকে ভারতের বিরুদ্ধে একের পর এক নোংরা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বাংলাদেশ। আর অন্যদিকে পাকিস্তান আর বাংলাদেশ একে অপরের কাছাকাছি আসছে ক্রমশ। বাংলাদেশে প্রভাব বাড়াতে মরিয়া পাকিস্তানও। মিশরের রাজধানী কায়রোতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস। বৃহস্পতিবার ডি-৮ সম্মেলনের সাইডলাইনে তারা দুজনের মধ্যে আলোচনা করেন।”
আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম- “পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক চাইছে ইউনূসের বাংলাদেশ, মেটাতে চায় একাত্তরের সমস্যাও।”
হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানকে বয়কটের আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার খবরটিও দিয়েছে।
গত কিছু দিন ধরে ভারতের সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাও করে আসছে ইউনূসের সরকার। বলা হচ্ছে, ভারতের সংবাদমাধ্যম থেকে বাংলাদেশ নিয়ে অপপ্রচার চলছে। তারমধ্যেই ইউনূসের সঙ্গে শেহবাজের বৈঠক বড় খবর হয়ে এল পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মাঝে থাকা ভা