নাটাই কি জেনারেল ওয়াকারের হাতছাড়া?

সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ জামান। ফাইল ফটো।
সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ জামান। ফাইল ফটো।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন সবাইকে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনের কথা। তার চড়া সুরের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলছিলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। কিন্তু হঠাৎ আন্দোলন এবং সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসা নানা প্রশ্ন তুলেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের প্রভাব এখন আর ঠিকভাবে কাজ করছে না, তা মনে হওয়ার কারণ রয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস যেভাবে চাইছেন, সেভাবেই যে হচ্ছে, সেটাও মনে হওয়ার কারণ নেই। আবার অভ্যুত্থানের তরুণ তুর্কিদের কথাই যে শেষ কথা, তাও বোঝার উপায় নেই। কারণ নইলে দাবি আদায়ে তাদের এত দর কষাকষিতে যেতে হত না।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আকস্মিক সিদ্ধান্ত এবং তার পরপরই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত দলটির নিবন্ধন স্থগিতে নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় এই প্রশ্নটিই বড় হয়ে উঠেছে, বাংলাদেশে ক্ষমতার নাটাই এখন কার হাতে?

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ‍ওঠেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। তাকে কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবেই দেখতে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহল। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনিই ছিলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে ইউনূস বলেছিলেন, ছাত্ররাই তাদের নিয়োগকর্তা। তখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণরাই আবির্ভূত হয়েছিল। তাদের কথায়ই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারেও দায়িত্ব নেন তিনজন।

তবে এরপর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধসহ নানা বিষয়ে অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে ইউনূস সরকারের দূরত্ব দৃশ্যমান হতে শুরু করে। অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিনে তৎপর থাকলেও ‘সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেবে না’ বলে তখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন জেনারেল ওয়াকার।

তবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হঠাৎ সুর চড়া করেন সেনাপ্রধান ওয়াকার। এক অনুষ্ঠানে তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলে ওঠেন, “আই হ্যাড এনাফ, লাস্ট সেভেন অর এইট মান্থ আই হ্যাড এনাফ।”

নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে যে হবে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দেন তিনি। রাজনৈতিক দলগুলোকে হুঁশিয়ার করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস যে তার কথার বাইরে যাচ্ছেন না, তাও বুঝিয়ে দেন তিনি।

তার সেদিনের বক্তব্যে কেউ কেউ পান ‘বাঘের গর্জন’র আমেজ, অনেকেই পান কর্তৃত্বের সুর। এরপর ইউনূসও নির্বাচনের সময় নিয়ে নিজের আগের কথা থেকে সরে এসে ডিসেম্বরের কথাই বলেন।

তবে মার্চ মাসের প্রথম ভাগে এসে সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর তোলেন অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা থেকে নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠকের দায়িত্ব নেওয়া হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি দাবি করেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে তাদের চাপ দিচ্ছেন জেনারেল ওয়াকার।

তিনি এক ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, গত ১১ মার্চ দুপুরে সেনানিবাসে এক বৈঠকে তাদের প্রস্তাব দেওয়া হয় আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আসার প্রস্তাব মেনে নিতে। বিনিময়ে নির্বাচনে কিছু আসন দেওয়ার কথাও বলা হয়।

তার ভাষ্যমতে, সেনাপ্রধান ওয়াকার তাদের অর্বাচীন বলার পাশাপাশি এটাও বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগ ছাড়া ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচন হবে না।

হাসনাত তার আন্দোলনের সহকর্মী এবং বর্তমানে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একটি ভিডিও শেয়ার দেন, যেখানে আসিফ বলছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা পদে ইউনূসকে মানতে সেনাপ্রধান নারাজ ছিলেন।

হাসনাতের বক্তব্য নিয়ে ঝড় উঠলে সেনাবাহিনীর পক্ষে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজ দাবি করে, তাদের কাছে দেওয়া এক বক্তব্যে সেনাসদর হাসনাতের কথাকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। হাসনাত ‘রাজনৈতিক স্টান্টবাজি’ করছেন বলেও মন্তব্য করা হয়।

তবে এরপর নির্বাচন নিয়ে আবার আগের অবস্থানে চলে যান ইউনূস। বিএনপির প্রবল বিরোধিতার পরও তিনি বলতে থাকেন, নির্বাচন হবে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুলাইয়ের মধ্যে। এরপর গত এপ্রিল মাসের প্রথম ভাগে জেনারেল ওয়াকার যখন রাশিয়া সফরে, তখন আকস্মিকভাবেই জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা খলিলুর রহমানকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে নিয়োগ দেন ইউনূস। এর আগে তিনি রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দায়িত্বে ছিলেন।

সেনাপ্রধানের অবর্তমানে তার মাথার ওপর কাউকে বসানোর সিদ্ধান্তটি জেনারেল ওয়াকারের মনঃপুত হয়নি বলে সেনা সূত্রে খবর মিলেছে। সূত্রটি বলছে, নানা দিক থেকে জেনারেল ওয়াকার এক ধরনের চাপে রয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান। ফাইল ছবি।

আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দিকে গত বছরের জুন মাসে সেনাবাহিনী প্রধান হিসাবে নিয়োগ পান ওয়াকার। বৈবাহিক সূত্রে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার আত্মীয়তা তখন আলোচনায় উঠেছিল।

তার পরের মাসেই জুলাই আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনীও নামিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু সেনাবাহিনী শেষ দিকে বেঁকে বসায় আর টিকে থাকতে পারেননি শেখ হাসিনা।

সেনাবাহিনীর তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ার কারণ সম্প্রতি স্পষ্ট হয় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্কের কথায়। তিনি বলেছিলেন, সরকারের নির্দেশে দমন-পীড়নে যুক্ত না হতে তখন তারা সেনাবাহিনীকে শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।

চাপে থাকা সেনাপ্রধান গত ১০ মে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আগে ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে নানা সূত্র খবর দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এনসিপির ডাকে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি চলার মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদের ওই বৈঠক বসেছিল। তার দুদিন আগে এনসিপি মাঠে নামার ঠিক আগ মুহূর্তে তথ্য উপদেষ্টার পদে থাকা জুলাই অভ্যুত্থানের ‘মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ আলম এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, তিনি ও আসিফ উপদেষ্টার পদে থাকলেও সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সম্মিলিত যোগসাজশে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

তার সেই পোস্টের পরই আন্দোলনে নামা এবং সেই দাবি মানায় নানা কৌতূহল তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

অভ্যুত্থানের সমর্থক প্রবাসী ইউটিউবার পিনাকী ভট্টাচার্য্য গত ফেব্রুয়ারিতে দাবি করেছিলেন, সেনাপ্রধান ওয়াকার ইউনূসের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে চাইছেন।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগে অবস্থানে সমর্থন দেওয়ার পর পিনাকী লিখেছেন, “তিনি (জেনারেল ওয়াকার) বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার উপর চাপ প্রয়োগ করার আহ্বান জানান … তবে বৈঠক শেষে গভীর রাতে ‘আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধের’ সিদ্ধান্তের খবর শুনে সেনাপ্রধান মুষড়ে পড়েন।

“শীর্ষ সেনা নেতৃত্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন ঘটানোর পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে তিনি গতকাল রবিবার সারাদিন তার অনুগত কিছু সেনা কর্মকর্তাদের সাথে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর, বাংলাদেশের সেনা নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো থেকে নিজেদের লোক ছাড়া অন্যদের সরিয়ে দিতে চাইছে ইন্ডিয়া।”

মিয়ানমার সঙ্কটকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ নিয়ে পরাশক্তিগুলোর নানা ছকের খবর এরই মধ্যে আসছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সহযোগিতা করছে বলেও দাবি করেছে ভারতের একটি সংবাদপত্র।

এদিকে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনকে ঠেকানোর বিষয়টি মাথায় রেখে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র যাই করবে, ভারতকে সঙ্গে রেখেই করবে। আর কোনো দেশে শক্তিশালী নির্বাচিত সরকারের বদলে জনভিত্তিহীনর দুর্বল সরকার থাকলে প্রতিবেশী যে কোনো দেশের প্রভাব খাটাতে যে সুবিধা, তা কে না জানে?

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

জেনারেল ওয়াকার কি তবে এবার নাটাই হাতে নিলেন

আরও পড়ুন