নতুন দলেও উপেক্ষিত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র সংসদের নতুন কমিটি ঘোষণার সময় সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের সংঘর্ষ বাঁধে।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র সংসদের নতুন কমিটি ঘোষণার সময় সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের সংঘর্ষ বাঁধে।

অভ্যুত্থানকারী তরুণদের গড়া নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান হলো ঘটা করে।

ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে অনুষ্ঠানের মঞ্চে অর্ধ শতাধিক নেতা-সংগঠক উপস্থিত ছিলেন, তার মধ্যে অন্তত ১২ জন বক্তব্য রাখেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শুধু নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসনাত অপু।

তার নাম ঘোষণার আগে বলা হচ্ছিল জুলাই অভ্যুত্থানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদানের কথা। ঘোষক বলছিলেন, “১৮ জুলাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কারণেই আন্দোলন অভ্যুত্থানের পথে যাত্রা শুরু করে।”

গত বছরের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন আওয়ামী লীগ সরকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দিলে মূল কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন গতি হারিয়েছিল।

স্তিমিত সেই আন্দোলনে গতির সঞ্চার করেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ঢাকার বাড্ডা-রামপুরা, উত্তরায় তারা আন্দোলন চাঙা করে রাখে।

আওয়ামী লীগ সরকারের দমন অভিযানও তাদের ওপরই বেশি চলে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বেশি নিহত হয়। তারপরও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো পর্যন্ত তারা ছিল মাঠে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসনাত অপু বক্তব্য রাখেন।

সেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের পক্ষে বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে অপু বলেন, “আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, ২০১৫ সালে কালো ভ্যাটের সময় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা রাজপথে আন্দোলন করে দাবি আদায় করে নিয়েছিল।”

তারপর ২০১৮ থেকে ২০২৪ কোনো আন্দোলনে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা পিছপা হয়নি জানিয়ে জুলাই আন্দোলনের প্রসঙ্গে আসেন তিনি।

অপু বলেন, “আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, যেদিন এই দেশের মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিল একদল তরুণ তাদের ভাই-বোনদের জন্য, তারা প্রাইভেট।”

আগামীতেও দেশের যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিঃস্বার্থ আত্মদানে প্রস্তুত বলে জানান তিনি।

অপুর ভাষণ উজ্জীবনী হলেও এই সমাবেশের শেষভাগে যখন নতুন দলের কমিটি ঘোষণা করা হয়, তখন দেখা যায় যে মূল নেতৃত্বের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউই নেয়।

শীর্ষ ১০ পদের মধ্যে প্রায় সব কয়টিতে যারা এসেছেন, তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা, প্রধান সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ, মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম সবারই পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের শিক্ষার্থী কেবল তাসনিম জারা। তিনি পেশায় চিকিৎসক।

নতুন দলের আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি যখন বৈষম্যবিরোধীদের নতুন ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কমিটি ঘোষণা করা হয়, তাতেও দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্য।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যাপ্ত প্রতিনিধি না থাকায় সেদিন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে কমিটি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনের আগে বিক্ষোভ শুরু করেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বিক্ষোভরত সেই শিক্ষার্থীদের ওপর সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা-কর্মীরা দুই দফা হামলা চালায় বলে অভিযোগ ওঠে।

হামলার আগে বিক্ষোভে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারিকুল ইসলাম সেদিন সাংবাদিকদের বলেছিলন, “জুলাই আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি আমরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছি। নতুন ছাত্র সংগঠনে আমাদের বাদ রেখে কমিটি যেন না দেওয়া হয়, সেজন্য আমরা বিক্ষোভ করছি।”

হামলার পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী নাহিদ বলেন, “১৭ জুলাইয়ের পর আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। কিন্তু এখন, আমাদের সম্পূর্ণভাবে কমিটি থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। যখন আমরা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলাম, কিছু লোক আমাদের উপর হামলা করেছে।”

বৃহস্পতিবার বিক্ষোভের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। তবে পরে সেই কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও ক্ষোভ চলছিলই।

কর্মসূচি স্থগিতের প্রতিক্রিয়ায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের সমন্বয়ক নাফসিন মেহনাজ বলেন, “আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল সিন্ডিকেট নিজেদের স্বার্থের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আাঁতাতে মিলিত হয়েছে। তারাই এখন প্রাইভেটের শিক্ষার্থীদের সাথে প্রতারণা করছে।”

তাদের এই ক্ষোভ চলার মধ্যে নতুন দলের শীর্ষ পদগুলোতেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে না রাখায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সোশাল মিডিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গ্রুপগুলোতে।

‘Private University Students Alliance of Bangladesh – PUSAB (Official)’ ফেইসবুকে এই গ্রুপটিতে একের পর এক পোস্ট করছে ক্ষোভ থেকে।

একজন লিখেছেন- “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য—

১. ঢাবি গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ

২. ছাত্র উপদেষ্টার ৩ জনই ঢাবির

৩. নতুন দলের শীর্ষ ১০ জনই ঢাবির”

তারপর জুড়েছেন- “১৭ তারিখ হল ছেড়ে পালানো ঢাবির শিক্ষার্থীরা নতুন বন্দোবস্ত করতেছে, অথচ ১৭ তারিখের পর তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ইন্টারমিডিয়েট লেভেলের শিক্ষার্থী, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং মাদ্রাসার ছাত্ররাই মূলত জুলাইকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ এখন সবাই মাইনাস।

“কোটা না মেধা? ঢাবি স্বৈরাচার!!!”

আরেকজন লিখেছেন, “জীবনে প্রথমবার শুনলাম যে প্রাইভেটের ছেলে-মেয়েরা ছাড়া নাকি পার্টি জমে। দেখব। এসো পরের বার। আমরাও পার্টি করব তখন।”

জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীও না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে একজন লিখেছেন- “গুলি হয়েছে রামপুরায়, গুলি হয়েছে বাড্ডায়। মধুর ক্যান্টিনে গুলি হয় নাই।”

বঞ্চনা এড়াতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের নিজস্ব আলাদা প্লাটফর্ম তৈরির প্রস্তাবও দিয়েছেন কেউ কেউ।

ক্ষোভমিশ্রিত এসব পোস্ট দেখে আবার কেউ কেউ সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন; বলছেন, “ভাই, বিভাজনমূলক পোস্ট পরিহার করুন। এই বিভাজন আবার স্বৈরাচারের হাতে আমাদেরকে বন্দি করবে।”

তবে তাতেও ক্ষোভ দমছে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

নাহিদ-আখতারের নেতৃত্বে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টির’ আত্মপ্রকাশ

আলোচনায় কিংস পার্টি, ইতিহাস কী বলে

বৈষম্যবিরোধীদের নতুন দল: নাম কী, নেতা কে, কোন আদর্শে

আসছে নতুন দল, ভোটে লড়তে লাগবে কী

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ads