ইউনূস-ওয়াকার টক্করে, জসিম বিপাকে করিডোরে

Yunus-Waker

অভ্যুত্থানের ১০ মাস পর ক্ষমতার ভরকেন্দ্র নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের দ্বন্দ্ব এখন ব্যাপক আলোচনায়।

গত ফেব্রুয়ারিতে সেনাপ্রধান ওয়াকারকে চালকের আসনে মনে হলেও দুই মাসেই দৃশ্যপট যায় পাল্টে; ইউনূস চলে আসেন নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়।

এখন ওয়াকার আবার তার নিয়ন্ত্রণ পোক্ত করতে চাইছেন বলে বিভিন্ন সূত্রের খবর; তাতে সেনা অভ্যুত্থানের গুঞ্জন জোরদার হয়েছে।

জেনারেল ওয়াকারের ১১ মে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার কথা ছিল, তা ইউনূস আটকে দেন। এরপর ওয়াকার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীনে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. কামরুল হাসানকে বরখাস্তের উদ্যোগ নেন। তবে তা ব্যর্থ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় ইউনূসের হস্তক্ষেপে।

বিভিন্ন সূত্রের খবর, রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের দ্বন্দ্বে এসব ঘটনা ঘটছে।

ইউনূস ও খলিল যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া অনুযায়ী এই করিডোর প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে চান। আর প্রতিবেশী দেশের দ্বন্দ্বের মধ্যে সেনাবাহিনীকে জড়াতে রাজি হচ্ছেন না ওয়াকার।

সেই করিডোরে আপত্তি তুলে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিরাগভাজন হয়ে চাকরি হারাতে বসেছেন বলেও খবর চাউর হয়েছে।

বিয়ের সূত্রে শেখ হাসিনার আত্মীয় ওয়াকার গত বছরের মে মাসে সেনাপ্রধান পদে নিয়োগ পান। তার দুই মাসের মধ্যে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে ৫ আগস্ট বেশ তৎপর দেখা গিয়েছিল তাকে।

কিন্তু এরপর তিনি নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে রেখেছিলেন। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে হঠাৎ চড়া সুরে কথা বলেন তিনি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলে ওঠেন, “আই হ্যাড এনাফ, লাস্ট সেভেন অর এইট মান্থ আই হ্যাড এনাফ।”

নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে যে হবে, সেই বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দেন তিনি। রাজনৈতিক দলগুলোকে হুঁশিয়ার করেন তিনি। ইউনূস যে তার কথার বাইরে যাচ্ছেন না, তাও বুঝিয়ে দেন তিনি।

তার সেদিনের বক্তব্যের পর ইউনূসও নির্বাচনের সময় নিয়ে নিজের আগের কথা থেকে সরে এসে ডিসেম্বরের কথাই বলেন।

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান।

তবে পরের মাসেই সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আলোচনার ঝড় তোলেন অভ্যুত্থানের নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি দাবি করেন, সেনাপ্রধান আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে পুনর্বাসিত করতে চাইছেন। সেজন্য তাদের ওপর চাপ দিচ্ছেন তিনি।

হাসনাত তার আন্দোলনের সহকর্মী এবং বর্তমানে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার একটি ভিডিও শেয়ার দেন, যেখানে আসিফ বলছিলেন, অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় প্রধান উপদেষ্টা পদে ইউনূসকে মানতে সেনাপ্রধান নারাজ ছিলেন।

এর প্রতিক্রিয়ায় সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজকে দেওয়া এক বক্তব্যে সেনাসদর হাসনাতের কথাকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার’ বলে উড়িয়ে দেয়। হাসনাত ‘রাজনৈতিক স্টান্টবাজি’ করছেন বলেও মন্তব্য করা হয়।

তবে সেনাপ্রধানের হাত থেকে যে নাটাই সরে গেছে, তা বোঝা যায় এরপর ইউনূসের নানা পদক্ষেপে।

গত এপ্রিলে জেনারেল ওয়াকার রাশিয়া সফরে থাকার সময় ইউনূস জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদে বসান খলিলকে। দীর্ঘদিন জাতিসংঘে কাজ করে আসা খলিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছের লোক হিসেবেই পরিচিত।

নির্বাচন নিয়েও আগের অবস্থানে ফিরে যান ইউনূস; তিনি বলতে থাকেন, ন্যূনতম সংস্কার হলে নির্বাচন ডিসেম্বরের মধ্যে হতে পারে, ব্যাপক সংস্কার হলে নির্বাচন পিছিয়ে চলে যেতে পারে আগামী বছরের জুনে।

অভ্যুত্থানকারীদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি দাবি তোলার পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তও নেয় উপদেষ্টা পরিষদ। সেই সিদ্ধান্ত ঠেকাতে জেনারেল ওয়াকার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন বলেও খবর আসে।

এরপর যুক্তরাষ্ট্র সফর আটকে দেওয়ার পর সেনাপ্রধান ওয়াকার নিজের কর্তৃত্ব বাড়াতে আবার সক্রিয় হয়ে উঠলে দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে দাবি করেছেন ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী।

তিনি নর্থ ইস্ট নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেন, গত ১১ মে সেনাপ্রধান ওয়াকার পিএসও লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুলকে বরখাস্তের উদ্যোগ নেন।

অভ্যুত্থানের পর গত বছরের আগস্টে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও পদে কামরুলকে বসিয়েছিলেন ইউনূস। এই পদটি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীন।

গত বছরের আগস্টে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের র‌্যাংক ব্যাজ পরানো হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসানকে।

কামরুলের নেতৃত্বেই গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের একটি সামরিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করে এসেছিল।

চন্দন নন্দী দাবি করছেন, রাখাইনে সহায়তা পৌঁছতে কক্সবাজার দিয়ে একটি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা নিয়ে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে একটি বিভাজন তৈরি হয়েছে।

মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের মদদ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে কয়েক মাস আগেই খবর দিয়েছিলেন চন্দন নন্দী।

গত ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরের সময় এই করিডোরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তবে গত মাসে এনিয়ে সরকার তৎপর হয়ে ওঠে।

নর্থ ইস্ট নিউজের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইউনূস ও খলিল এই করিডোর প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যেতে চাইলে বাদ সাধেন জেনারেল ওয়াকার।

এক্ষেত্রে জেনারেল ওয়াকারের পক্ষে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তা, জিওসি রয়েছেন বলে ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।

সেই কারণেই ওয়াকারের যুক্তরাষ্ট্র সফর বাতিল হয় বলে দাবি করা হচ্ছে। চন্দন নন্দীর দাবি, এক্ষেত্রে কলকাঠি নেড়েছেন খলিল। তিনি ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রাসি জ্যাকবসনের সঙ্গে বৈঠক করে তা আটকে দেন।

জেনারেল ওয়াকারের এই সফর ১২ দিনব্যাপী হওয়ার কথা ছিল। হাওয়াইয়ে ল্যান্ড ফোর্সেস প্যাসিফিকের গুরুত্বপূর্ণ সভায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল।

ওই সফর বাতিল হওয়ার পর যখন ওয়াকার পিএসও কামরুলকে বরখাস্তের উদ্যোগ নেন, তখন কামরুল যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের কাছে ছুটে গিয়েছিলেন বলে সেনা সূত্রের বরাতে চন্দন নন্দী জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ওয়াকার তৎপর হতেই কামরুল যান বারিধারায় যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জ্যাকবসনের বাড়িতে। দুই ঘণ্টা তারা আলোচনা করেন। এরপর ওয়াকারের তৎপরতা ঠেকিয়ে দেওয়া হয়।

অবশ্য দ্য সান ২৪ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে ওই বৈঠকটি ট্রাসি জ্যাকবসনের সঙ্গে নয়, বরং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের সঙ্গে হয়েছিল।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার পক্ষে বলে জানা যাচ্ছে। তিনি চাইছেন, মিয়ানমার সীমান্তে বিজিবিকে সরিয়ে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিতে।

খলিলুর রহমান তিন বাহিনীর প্রধানদের বাদ দিয়ে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) এবং কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) এই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে সব কাজ চালাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।

এদিকে ওয়াকারের তৎপরতার পেছনে ভারতের ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করছেন অভ্যুত্থানের পক্ষের অনেকে।

পররাষ্ট্র সচিব জসিম বিপাকে

অভ্যুত্থানের পর পররাষ্ট্র সচিবের পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন পেশাদার কূটনীতিক জসিম উদ্দিন।

তিনি নোয়াখালীর চাটখিলের এক সময়ের বিএনপির সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন কামরানের ভাই হলেও তাকে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট হিসাবে দেখছিল অভ্যুত্থানের পক্ষের কেউ কেউ।

পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন।

চন্দন নন্দী জানিয়েছেন, রাখাইনে মানবিক করিডোরের বিরোধিতা করার পর জসিমকে এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রের বরাতে তিনি নর্থ ইস্ট নিউজে লিখেছেন, ইউনূস ও খলিল মিলে জসিমকে সরিয়ে দিচ্ছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।

প্রধান উপদেষ্টার এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন বলে নানা সূত্রের খবর। লামিয়া এক সময় ইউনূস সেন্টারের পরিচালক ছিলেন, ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর তাকে সরকারি পদ দেন।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিল এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপরও ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে। এতে অস্বস্তিতে পড়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।

করিডোর প্রতিষ্ঠা নিয়ে তৌহিদ হোসেন নিমরাজি হলেও পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন কিছু কূটনৈতিক বিষয় তুলে দ্বিমত জানিয়েছিলেন।

তাতে তাকে জসিমকে বিএনপি ঘরানার হিসাবে চিহ্নিত করে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে সরকার নিয়ে ফেলেছে বলে নানা সূত্রে জানা যায়। জসিমের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদও স্থগিত করার খবর শোনা যাচ্ছে।

জসিমকে কর্মহীন করে খলিলের নির্দেশনায় লামিয়া মোরশেদ এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সব মেইল ও নোট ভার্বালও এখন লামিয়া মোরশেদের নামেই আসতে দেখা যাচ্ছে।

জসিমকে সরিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে জামায়াত সমর্থক হিসেবে পরিচিত মো. নজরুল ইসলামকে আনার কথাও শোনা যাচ্ছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর:

নাটাই কি জেনারেল ওয়াকারের হাতছাড়া?

জেনারেল ওয়াকার কি তবে এবার নাটাই হাতে নিলেন

আরও পড়ুন