একের পর এক আন্দোলনে দৃষ্টি যখন ঢাকায় কেন্দ্রীভূত, ভেতরে ভেতরে রাখাইন করিডোরের পথ নকশাও প্রায় চূড়ান্ত। সিলখালি এবং নাইক্ষ্যংছড়ির মধ্যে ৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পথ চিহ্নিত করা হয়েছে করিডোরের জন্য, যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১০ম পদাতিক ডিভিশনের রামু সদর দপ্তরের কাছে অবস্থিত।
এপথ দিয়েই মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে রাখাইন রাজ্যে সরবরাহ পাঠানোর পরিকল্পনা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রের খবর।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অন্তর্গত এই পথটি মূলত পাহাড়ি এবং বনভূমিতে পরিপূর্ণ। নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে সিলখালির দিকে যাওয়ার জন্য প্রধান সড়কটি হলো নাইক্ষ্যংছড়ি-ঘুমধুম সড়ক। এই সড়ক নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন থেকে শুরু হয়ে ঘুমধুম ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে সিলখালিতে পৌঁছায়।
করিডোর নিয়ে চলমান কৌশল সম্পর্কে অবগত একাধিক ব্যক্তি এই পথনকশার সর্বশেষ অগ্রগতি নিশ্চিত করেছেন।
আর এই আলোচনায় একদিকে তিন বাহিনীর প্রধান এবং অন্যদিকে ‘মানবিক করিডোর’ প্রস্তাবনার ‘মাস্টারমাইন্ড’ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) খলিলুর রহমান। তাদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই রুট চিহ্নিতকরণ এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য কৌশলগত পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্রের খবর।
রাখাইনে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান যতোটা আগ্রহী, ঠিক ততোটাই অনাগ্রহী বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। প্রতিবেশী দেশের দ্বন্দ্বে সেনাবাহিনীকে জড়াতে রাজি হচ্ছেন না তিনি।
আর করিডোরে আপত্তি তুলে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিরাগভাজন হয়ে চাকরি হারাতে বসেছেন বলেও খবর চাউর হয়েছে।
এরকম আলোচনার মাঝেই ১৬ মে রাত ১১টার দিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, বিমানবাহিনী প্রধান হাসান মাহমুদ খান এবং নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসানের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন খলিলুর রহমান। প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী বৈঠকেও মতপার্থক্য দূর করা সম্ভব হয়নি বলে দাবি করেছেন ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী।
তিনি নর্থ ইস্ট নিউজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করেন, ওই বৈঠকে করিডোর প্রশ্নে খলিলুরকে সেনাবাহিনীর তরফে যিনি সমর্থন জোগাচ্ছেন, সেই প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসান অবশ্য ছিলেন না।
সূত্রের খবর, গত ১১ মে সেনাপ্রধান ওয়াকার কামরুলকে বরখাস্তের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যাকে অভ্যুত্থানের পর গত বছরের আগস্টে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের পিএসও পদে বসিয়েছিলেন ইউনূস। এই পদটি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অধীন।
কামরুলের নেতৃত্বেই গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের একটি সামরিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করে এসেছিল।
আগেই চন্দন নন্দী দাবি করেছিলেন, রাখাইনে সহায়তা পৌঁছতে কক্সবাজার দিয়ে একটি মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা নিয়ে সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ে বিভাজন তৈরি হয়েছে। মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের মদদ দিতে ‘যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায়’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলেও খবর দিয়েছিলেন তিনি।

বিভাজন যখন স্পষ্ট সেখানে কলকাঠি নাড়ছেন মার্কিন নাগরিকত্বের অধিকারী খলিলুর, যাকে উড়িয়ে এনে বিশেষ দায়িত্বে বসিয়েছিলেন ইউনূস। গত ১১ মে হাওয়াইয়ে ল্যান্ড ফোর্সেস প্যাসিফিকের গুরুত্বপূর্ণ সভা থেকে ওয়াকারের নাম প্রত্যাহারের পেছনে তার হাত রয়েছে বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।
খলিলুর ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের বৈঠক করে তা আটকে দেন। জেনারেল ওয়াকারের এই সফর ১২ দিনব্যাপী হওয়ার কথা ছিল।
খলিলুর রহমান তিন বাহিনীর প্রধানদের বাদ দিয়ে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) এবং কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল (কিউএমজি) এই দুজনকে সঙ্গে নিয়ে সব কাজ চালাচ্ছেন বলেও জানা যাচ্ছে। আর ওয়াকারের তৎপরতার পেছনে ভারতের ইন্ধন রয়েছে বলে দাবি করছেন অভ্যুত্থানের পক্ষের অনেকে।
এদিকে ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আফতাব হোসেনকে তার সরকারি মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন “কার্যকলাপে যুক্ত থাকার” দায়ে মিয়ানমার থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
২৩ মার্চ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন ঢাকা ভিত্তিক মার্কিন দূতাবাসের সামরিক অ্যাটাশে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাইকেল ই ডি মিচি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হান্টার গ্যালাচার এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মেজর ইয়ান লিওনার্ডের নেতৃত্বে তিন সদস্যের মার্কিন কর্মকর্তাদের একটি দলের সাথে দেখা করেছিলেন বলে সূত্রের খবর।
১৩ মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আফতাব হোসেনকে “জরুরিভাবে” দেশে ফিরে যেতে বলা হয়েছে।
রাজশাহীর একটি পদাতিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাকে নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর তাকে বিবেচনা করছে।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ আলিমুল আমিনসহ অপারেশনস অ্যান্ড প্ল্যান ডিরেক্টরেটের কর্মকর্তারা সিলখালি থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি রুট চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও, এই অংশের কার্যক্রম সম্ভবত শামলাপুর, বালুখালী, ঘুমধুম, উখিয়া হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত পরিচালিত হবে, যেখান থেকে ১০ম পদাতিক ডিভিশনের সদর দপ্তর রামু মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে।
অবশ্য সিলখালি-নাইক্ষ্যংছড়ি রুটের অবস্থা সঙ্গিন হওয়ায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত জুড়ে সরবরাহ কার্যকর এবং মসৃণভাবে সরবরাহের জন্য অনেক অংশে নতুন করে রাস্তা তৈরি করতে হতে পারে।
এদিকে চারদিকে যখন নানা আলোচনা এর মধ্যেই আইএসপিআরের পৃথক দুই বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা সেনানিবাস বা ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে সব ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নাশকতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে শনিবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক সাবেক সেনাসদস্যসহ তিনজনকে।
এ সম্পর্কিত আরও খবর:
ইউনূস-ওয়াকার টক্করে, জসিম বিপাকে করিডোরে
নাটাই কি জেনারেল ওয়াকারের হাতছাড়া?
জেনারেল ওয়াকার কি তবে এবার নাটাই হাতে নিলেন
রাখাইনে মানবিক করিডোর: অনির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ, বিতর্ক