বিশেষ ক্ষমতা আইনের ‘নীরব’ প্রয়োগ চলছেই, আটক অনেকে

Special Act

সব ধরনের ‘কালো আইন’ বাতিলের কথা বলে এলেও অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে থেমে নেই বিতর্কিত ‘বিশেষ ক্ষমতার’ প্রয়োগ। মিস আর্থ বাংলাদেশ-২০২০ বিজয়ী মডেল মেঘনা আলমকে বাসা থেকে জোরপূর্বক তুলে নেওয়ার পর বিষয়টি সামনে এলেও মূলত এর প্রয়োগ হয়েছে এর আগেও।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আটকাদেশের ক্ষেত্রেও ‘নীরবে’ প্রয়োগ হচ্ছে আইনটি।

দ্য সান ২৪-এর হাতে এমন একটি আদেশের অনুলিপি রয়েছে যেখানে দেখা গেছে এই আইন প্রয়োগ করে চট্টগ্রামের একজন সাবেক নারী কাউন্সিলর, পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শকসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেওয়া হয়েছে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে।  

অবশ্য মডেল মেঘনা আলম গ্রেপ্তারের ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন, খোদ আইন উপদেষ্টা এখন দাবি করছেন ‘বিষয়টি সঠিক হয়নি’।

মেঘনাই প্রথম নন

সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই নথিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামের চারজনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-২ গত ৮ এপ্রিল ওই আদেশ জারি করে, যেখানে ১১ মার্চ থেকে আটকাদেশ জারির কথা বলা হয়েছে।

৮ এপ্রিলের আদেশে মূলত আগের আটকাদেশের মেয়াদ বর্ধিত করার কথা জানানো হয়।  

সিনিয়র সহকারী সচিব মো. জিয়াউল হক মীর স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ (১) ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী ক্ষতিকারক কাজ হতে বিরত রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার চারজনের আটককাদেশ বর্ধিত করা হলো।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে জারি করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশের অনুলিপি।

এরমধ্যে এক নম্বরে রয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক কাউন্সিলর রেখা আলম চৌধুরী।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়। তখন থেকে সাবেক কাউন্সিলর রেখা আলম চৌধুরী কারান্তরীণ।

কোনো মামলা না থাকলেও বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকে রাখা এই নারী নেত্রীর আটকাদেশের মেয়াদ দ্বিতীয় দফায় ১০ এপ্রিল থেকে পরর্বর্তী ৬০ দিনের জন্য বাড়ানো হয়।

এ ছাড়া বাংলাদেশ পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মশিউর রহমানকে গত ১৯  সেপ্টেম্বর ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। পরে সাত দিনের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ (১) ধারা প্রয়োগ করে তার আটকাদেশের মেয়াদও গত ১০ এপ্রিল থেকে ৬০ দিন বাড়ানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগর যুব মহিলা লীগের সদস্য জিন্নাত সুলতানা ঝুমার (৩৫) ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে একই আইন। তার আটকাদেশের মেয়াদও দুই মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে একই আইনের ক্ষমতাবলে।

এছাড়া চট্টগ্রামের হালিশহরের মিয়াখান নগর এলাকার দস্তগীর আহমদ সুমনের (৪৭) বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগ করেছে সরকার, বাড়ানো হয়েছে আটকাদেশের মেয়াদ।

নথি থেকে এটি স্পষ্ট বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ মডেল মেঘনা আলমের আটকের অনেক আগে থেকেই প্রয়োগ করে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার।

মেঘনাকে ঘিরে আলোচনা

গত বুধবার রাতে মডেল মেঘনা আলমকে রাজধানীর বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)।

মডেল মেঘনা আলম।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী, পরদিন বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমকে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের বিচারক সেফাতুল্লাহ।

আদালত বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩(১) ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে তাকে ৩০ দিনের জন্য কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।

সুনির্দিষ্ট কারণ না জানিয়ে মেঘনা আলমের আটকের ঘটনা নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। দাবি ওঠেছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও জানিয়েছে উদ্বেগ।

অ্যামনেস্টির উদ্বেগ

দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভেরিফায়েড এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে এক পোস্টে সংস্থাটি জানায়, বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই দমনমূলক আইনটি অস্পষ্ট ও অতিরিক্ত বিস্তৃত বিধানের মাধ্যমে অতীতে দীর্ঘ সময় ধরে বিচার ছাড়াই এবং কোনো আদালতের নজরদারি ছাড়াই মানুষকে স্বেচ্ছাচারভাবে আটক করতে ব্যবহৃত হয়েছে।

“এসব ঘটনাকে যথাযথ প্রক্রিয়াগত নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান ও সর্বোত্তম চর্চার চরম লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হয়,” যোগ করা হয় ওই পোস্টে।

আইনজীবীর ভাষ্য

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, “এই আইনের অনেক অপপ্রয়োগ হয়। এই আইন বিচারবহির্ভূতভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে থাকে। এটি সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার’- এর পরিপন্থী।”

আইনটির প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, আইনে সিএমএম কোর্টের এ ধরনের অনুমতি দেওয়ার কোনও সুযোগ নাই। আইন ব্যত্যয় করে যদি কাউকে অ্যারেস্ট করে, তাহলে তা সম্পূর্ণ অবৈধ।”

অবশেষে উপদেষ্টার সাফাই

মডেল মেঘনা আলমকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকের প্রক্রিয়া নিয়ে মন্তব্য এলেও তাদের সময়ে যে এই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে সে বিষয়টি অবশ্য এড়িয়ে গেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “মডেল মেঘনা আলমকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডিটেনশন দিয়েছিল। এ নিয়ে অনেক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। আপনাদের শুধু একটি জিনিস বলতে চাই, আমরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ নিয়ে মিটিং করেছি।”

সমালোচনার জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, “আমরা এ ব্যাপারে বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান এবং অন্য অনেকের বক্তব্যে সচেতন আছি। আমরা শুধু এটুকু আপনাদের বলতে পারি, মডেল মেঘনা আলমের ব্যাপারে পুলিশ কিছু তদন্ত করছে এবং ওনার বিরুদ্ধে কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কিন্তু ওনাকে যে প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে, সেটা সঠিক হয়নি।”

যা আছে বিশেষ আইনে

বাংলাদেশে এই বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ‘কালো আইন’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় এই আইনটি অপসারণের দাবি ওঠেছে, তবে কোনও সরকারই তা করেনি।

মূলত, পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের নয়ই ফেব্রুয়ারি এই আইনটি পাস করা হয়েছিলো।

এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করা। একই সাথে কিছু গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।

বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪’ বা ডিটেনশন আইন প্রয়োগ করে সরকার কোনও ব্যক্তিকে আদালতের আনুষ্ঠানিক বিচার ছাড়াই জননিরাপত্তা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সন্দেহভাজন হিসাবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আটক বা বন্দি করতে পারে।

এই আইনে রাষ্ট্র-বিরোধী কার্যকলাপের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা বিরোধী কার্যকলাপ, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতি সাধন, জননিরাপত্তা বিরোধী কাজ করা, জনসাধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা-সহ নানা বিষয়।

এছাড়াও, জনগণের মধ্যে বা জনগোষ্ঠীর কোনও অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা, দেশের আইন ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় বাধা দেওয়া এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা রাষ্ট্র-বিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

তবে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে এবং তাকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ জানাতে হবে।

হাই কোর্টের রুল

এদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মডেল মেঘনা আলমের ৩০ দিনের আটকাদেশ কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রোববার রুল জারি করেছে হাই কোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে মামলার বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রবিবার (১৩ এপ্রিল) বিচারপতি রাজিক আল জলিলের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, আইনজীবী জাহেদ ইকবাল, মো. শাহিনুজ্জামান প্রমুখ।

আরও পড়ুন