আন্দোলনে উত্তাল গত বছরের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ সরকার যখন কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামায়, তখন সেই বাহিনীর সাঁজোয়া যানে ‘ইউএন’ লেখা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে উঠেছিল।
রয়টার্সের একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকায় মেট্রোরেল স্টেশনের সামনে দিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যান। সাদা রঙের ভেতরেও ইউএন বা জাতিসংঘ লেখাটি ফুটে উছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর যানে ‘ইউএন’ লেখা থাকে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে থাকে।
তখন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছিল, বাংলাদেশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনে জাতিসংঘের সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিষয়টি তখন সাংবাদিকরা জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিকের নজরে আনলে তিনি বলেছিলেন, জাতিসংঘের নির্ধারিত কাজ ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে ‘ইউএন’ লেখা যানবাহন ব্যবহার করা যায় না।
সমালোচনার মুখে ২৫ জুলাই তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, ‘ভুল করে’ সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া যানে ‘ইউএন’ লেখা রয়ে গিয়েছিল।
তার ব্যাখ্যা ছিল, গাড়িটি এক সময় শান্তিরক্ষা মিশনে ব্যবহার হলেও এখন তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিজস্ব। তবে ‘ইউএন’ লেখাটি তোলা হয়নি।
কয়েকশ মানুষের প্রাণহানির মধ্য দিয়ে এরপর সেই আন্দোলন রূপ নিয়েছিল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনের।
বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনী নামালেও শেষ দিকে মাঠে থাকা সেনাবাহিনীকে দেখা গিয়েছিল নিরপেক্ষ ভূমিকায়। উল্টো বিক্ষোভকারীদের রক্ষা করে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঠেঙানোর ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেনাসদস্যরা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার খবর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামানের কাছেই প্রথম পায় দেশবাসী। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে বৈঠকও করেন তিনি। তারপর জানান, এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে।
ঘটনার শেষ সেখানেই হয়নি। সেই সরকার গঠনের সাত মাস পর আবার সেনাবাহিনীর ভূমিকা আবার আলোচনায় উঠল।
সেনাবাহিনী নিজ তাগিদে দেশ ও জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল- জেনারেল ওয়াকার সেদিন একথা বললেও তা প্রশ্নবিদ্ধ হলো জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ভলকার টুর্কের এক কথায়। তিনি দাবি করলেন, সেনাবাহিনীকে তারা চাপ দিয়েছিলেন। সতর্ক করেছিলেন শান্তিরক্ষা মিশন থেকে সরিয়ে দেওয়ার।
তার সেই বক্তব্য নিয়ে তুমুল আলোচনা ওঠার পর পাঁচ দিন বাদে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া এল। দাবি করা হল, জাতিসংঘ থেকে কোনো চাপই আসেনি তাদের কাছে, অভ্যুত্থানের সময় সেনাবাহিনীর দায়িত্বের তাগিদেই জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
অস্পষ্টতা দূর করতেই এই প্রতিক্রিয়া দেওয়ার কথা সেনাবাহিনী জানিয়েছে। তবে এটা আসলে মুখ রক্ষার চেষ্টা হিসাবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।
কী বলেছিলেন টুর্ক?
গত ৫ মার্চ বিবিসির হার্ড টক অনুষ্ঠানে কথা বলছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক। অনুষ্ঠানে কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিষয়টি আসে।
গাজা, ইউক্রেন, সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে ভলকার টুর্কের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল- আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধ মেনে এসব পরিস্থিতি সমাধানে জাতিসংঘকে কি ক্ষমতাহীন মনে হচ্ছে?
এর জবাব দিতে গিয়ে টুর্ক বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “আপনাকে আমি একটি উদাহরণ দিচ্ছি, যেখানে এটি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। আমি গত বছরের বাংলাদেশের উদাহরণ দিচ্ছি।”
জুলাই–অগাস্টে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সময় শেখ হাসিনার সরকারের দমন অভিযানের বিষয়টি তুলে তিনি বলেন, “আমরা কী বলি, আমি কী বলি, আমরা কী করতে পারি এবং আমরা ওই পরিস্থিতি কীভাবে আলোকপাত করি- সেটি নিয়ে তাদের বড় প্রত্যাশা ছিল।
“আমরা সেনাবাহিনীকে সতর্ক করি, যদি তারা এতে জড়িত হয়, তার অর্থ দাঁড়াবে তারা হয়ত আর শান্তিরক্ষী পাঠানোর দেশ থাকতে পারবে না। ফলে আমরা পরিবর্তন দেখলাম।”
এই পরিবর্তন বলতে বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনীর নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়াকেই বুঝিয়েছেন তিনি।
টুর্ক আরও বলেন, “আমরা এগুলোই করেছিলাম। এবং এটা কার্যত সাহায্য করেছিল। আমি গত বছর বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। আমরা একটি অবস্থান নেওয়ায়, আমরা কথা বলায় এবং তাদেরকে সমর্থন করায় শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ ছিল।”

২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রতি সতর্কবার্তার ইঙ্গিত আছে।
প্রতিবেদনের ১৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে— এমন আশঙ্কার কথা বিক্ষোভ চলাকালে জাতিসংঘ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল। সেটি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে সেনা কর্মকর্তাদের অনাগ্রহী করে তোলে।”
ভলকার টুর্কের বক্তব্য জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থকদের চোখে এক রকম হলেও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে অন্য রকম ঠেকছে। তারা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতে যে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল, তা এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে।
সেনাবাহিনী যা বলছে
ভলকার টুর্ক বক্তব্য দেওয়ার পাঁচ দিন পর সোমবার সেনাবাহিনীর পক্ষে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) একটি প্রতিক্রিয়া তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।
এই প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ব্যাখ্যায় বলা হয়, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মানবাধিকারের তাৎপর্য যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে এবং যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে। তবে অধিকতর সঠিকতা ও স্বচ্ছতার উদ্দেশ্যে উক্ত মন্তব্যের (ভলকার টুর্কের) কিছু বিষয়ে স্পষ্টীকরণ প্রয়োজন বলে মনে করে।
“মি. ভলকার টুর্কের মন্তব্য কিছু মহলের মাধ্যমে ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, যা সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি এবং এর পেশাদারিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।”
ভলকার টুর্ক যে সতর্ক করার কথা বলেছিলেন, সে বিষয়ে আইএসপিআর বলছে, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার থেকে এ বিষয়ক কোনো ইঙ্গিত কিংবা বার্তা সম্পর্কে অবগত নয়। যদি এ সংক্রান্ত কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়ে থাকে, তবে তা তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়ে থাকতে পারে, সেনাবাহিনীকে নয়।”
ফলে সেনাবাহিনীর তখনকার ভূমিকার ক্ষেত্রে কোনো চাপ ছিল না বলেই দাবি করা হয়েছে আইএসপিআরের প্রতিক্রিয়ায়।
তাতে বলা হয়, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুযায়ী কাজ করে এবং সর্বদা আইনের শাসন ও মানবাধিকার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
“নিরপেক্ষতা ও সততার মহান ঐতিহ্য ধারণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনগণের পাশে থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতীতের ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষত ১৯৯১ সালের গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কখনো জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করেনি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময়ও সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং কোনো পক্ষপাত বা বাহ্যিক প্রভাব ছাড়াই জননিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।”
শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ পড়লে সেনাসদস্যদের আয়ের একটি পথ বন্ধ হয়ে যাবে, তাই তারা বিক্ষোভ দমনে গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানান বলে এরই মধ্যে কথা উঠেছে।
আইএসপিআরের প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, “বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
“এখানে উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অর্জিত আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ শান্তিরক্ষীরা পেয়ে থাকেন এবং এর সিংহভাগ জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, যার পরিমাণ গত ২৩ বছরে প্রায় ২৭০০০ কোটি টাকা।”
নেপথ্যে কী?
বাংলাদেশে ক্ষমতার পট পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা রাখার ঘটনা অতীতে বিভিন্ন সময় ঘটেছে। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ও তার ব্যতিক্রম ছিল না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
আইএসপিআরের বক্তব্যে ১৯৯০ ও ২০২৪ সালের কথা বলা হলেও উহ্য থেকে গেছে ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের প্রসঙ্গটি, যেখানে সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল।
রাজনৈতিক সহিংসতার মধ্যে সেই হস্তক্ষেপেও জড়িয়ে রয়েছে জাতিসংঘ মিশন। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে এতে বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের অংশগ্রহণ ব্যাহত হতে পারে, এমন শঙ্কা থেকে হস্তক্ষেপ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ।
তখনকার ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জেনারেল মইনের লেখা ‘শান্তির স্বপ্নে : সময়ের স্মৃতিচারণ’ এ বলা হয়, “আমি প্রেসিডেন্টকে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি, নির্বাচন, বিরোধী রাজনৈতিক দলের আল্টিমেটাম এবং বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের অবস্থান, বিশেষ করে নির্বাচনের ব্যাপারে জাতিসংঘের দৃঢ় অবস্থানের কথা জানালাম।
“জাতিসংঘ মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করা হলে যে বিপর্যয় ঘটতে পারে, তা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানেরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে সচেষ্ট হলো।”
লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ তখনকার ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখেছেন ‘এক-এগারো’। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “২০২৪ ও ২০০৭ এর পটভূমিতে অনেক মিল আছে। রেজিমগুলো নিজেরাই তাদের পতনের শর্ত তৈরি করেছিল। তখনই কিন্তু বাইরের পক্ষগুলো ইন্টারভিন (হস্তক্ষেপ) করার সুযোগ পায়।”
সেনা সদস্যরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ার সুযোগ হারাতে চাইছিল না বলেই শেখ হাসিনা সরকার তাদের দিয়ে কাজ করাতে পারেনি বলে মনে করেন বিশ্লেষকদেন অনেকে।
মহিউদ্দিন বলেন, “তারা পিস কিপিং মিশনের সুযোগটা নষ্ট করতে চাইবে না, সেক্ষেত্রে বাহিনীর ভেতরেই সমস্যা দেখা দিত। ভলকার টুর্ক এটা রিকনফার্ম করলেন।”
অভ্যুত্থানের সময় জনগণের পাশে দাঁড়ানোর যে ভাবমূর্তি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন, ভলকার টুর্কের কথায় তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে আগেই মন্তব্য করেছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
তিনি বলেন, “সেনাপ্রধান বক্তব্য দিয়ে জনগণের পক্ষে থাকার যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন, এটা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ভলকার টুর্কের এমন সাক্ষাৎকারে এটা বোঝাই যাচ্ছে যে চাপে পড়েই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
দৃশ্যত সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতেই আইএসপিআর থেকে প্রতিক্রিয়া জানাতে হল।