আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এক সময় একজোট ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী, ক্ষমতাও ভাগাভাগি করেছিল তারা। জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এখন দুই দলের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এখন শত্রুতার দিকে গড়াচ্ছে।
উভয় দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরও এখন প্রতিপক্ষ। কিন্তু এই সংগঠন দুটির সম্পর্ক কখনও হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল না, এমনকি যখন বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ ছিল, তখনও নয়। দুই দলের শীর্ষ নেতাদের প্রভাবে দুই যুগ আগে সংগঠন দুটির ঐক্য হলেও তাতেও ছিল ছেঁড়াছেঁড়া ভাব। আর এখন তো তাদের কথার যুদ্ধ মাঠের মারামারিতেও জড়াচ্ছে।
জোট না হওয়ার জন্য শিবিরের নেতারা বরাবরই ছাত্রদল নেতাদের দায়ী করেছেন। আর ছাত্রদল নেতারা একাত্তরে ভূমিকার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিবিরের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠাকে দায়ী করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রদল ও শিবিরের পথচলার শুরু প্রায় একই সময়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি গঠনের পর এর ছাত্র সংগঠন হিসাবে ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্রদল প্রতিষ্ঠা করেন।
ছাত্রশিবির নামে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনটির যাত্রা শুরু জিয়ার আমলেই ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান আমলে জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ, যে দলটির নেতা-কর্মীদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল আল বদর বাহিনী। এই বাহিনীই মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন করেছিল।
স্বাধীনতার পর জামায়াতের পাশাপাশি শিবিরও ছিল নিষিদ্ধ। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়ার আমলে জামায়াত সক্রিয় হয়ে নতুন নামে ছাত্র সংগঠন তৈরি করে। তবে ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম আলীও ছিলেন একজনন যুদ্ধাপরাধী। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে পরে তার মৃত্যুদণ্ড হয়।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়া রাজনীতিতে ইসলামী দলগুলোকে পুনর্বাসিত করলেও বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের ঐক্য তখন হয়নি। ছাত্রদলের সঙ্গে শিবিরের সম্পর্কও তখন গড়ে ওঠেনি। বরং বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিবিরের দখলদারিত্ব আর রগ কাটা প্রতিরোধে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গেই ছিল ছাত্রদল।
১৯৮৯ সালে রাজধানীর পাশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতা হাবিবুর রহমান কবির শিবিরের হামলায় নিহত হলে ছাত্রদল নেতৃত্বাধীন জাকসুর উদ্যোগে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’ ব্যানারে ওই ক্যাম্পাসে শিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালের চাকসু নির্বাচনে শিবিরকে ঠেকাতে যে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে ওঠে,সেখানেও ছিল ছাত্রদল। সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগ, জাতীয় ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগসহ অন্য বাম সংগঠনগুলোর প্যানেলে ছাত্রদলও যুক্ত হয়েছিল। এজিএস পদে ছাত্রদলের মাহবুবের রহমান শামীম জিতেও ছিলেন।

ওই বছরের শেষে গণআন্দোলনের এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে নির্বাচনের পর জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি, সংসদে জামায়াতকে দুটি নারী আসনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে তেমন সদ্ভাব গড়ে ওঠেনি। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতারা শিবিরবিরোধী অবস্থানেই ছিলেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার কয়েক বছর পর জামায়াত, জাতীয় পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। তারপরই প্রথম ছাত্রদল-শিবিরকে মেলানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। মূলত খালেদা জিয়া ও গোলাম আযমের ইচ্ছায় ১৯৯৯ সালে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে শিবিরের বিভিন্ন নেতার কথায় জানা যায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদারে তখন তখন ছাত্রদল, শিবিরসহ আরও কয়েকটি সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন জেলায় কলেজে ছাত্রদল-শিবির যৌথ প্যানেল হলেও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এই ঐক্যে ছিল ছাড়াছাড়া ভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরকে প্রকাশ্য হতে কোনো সহায়তাও দেয়নি ছাত্রদল।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি জোটের ভিত্তিতে সরকার গঠন করে জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মো. মুজাহিদকে মন্ত্রী করে বন্ধন মজবুত করলেও ছাত্রদল-শিবিরের বাঁধন আলগাই থেকে যায়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যকে পুনরায় সক্রিয় করতে চেয়েছিল শিবির। ২০১০ সালে ঢাকায় কয়েকটি সংগঠনকে নিয়ে সভাও করেছিল। কিন্তু ছাত্রদল সাড়া দেয়নি।
শিবিরের সাবেক নেতা, কুমিল্লার মু আতাউর রহমান সরকার এক কলামে লিখেছেন, সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি রেজাউল করিম, সেক্রেটারি জেনারেল শিশির মনিরের নেতৃত্বে শিবির নেতারা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য গড়ে তুলতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ছাত্রদলের তৎকালীন সভাপতি সুলতান সালাহউদ্দীন টুকু, শফিউল বারী বাবুর অনীহার কারণে তা সফল হয়নি।
এরপর ২০১২ সালের অক্টোবরে ছাত্রদলকে বাদ দিয়েই সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠনের ঘোষণা দিয়ে সমমনা নয়টি ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে বৈঠক করে শিবির। সেই বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েও যায়নি ছাত্রদল।
বিএনপি ও জামায়াত যখন নিয়মিত বৈঠক করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তখনও ছাত্রদল ও শিবির নেতারা একে অন্যের মুখ দেখছিলেন না। তবে ছাত্রদলের অনীহার কারণেই তাদের জোট হয়নি বলে বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় খবর আসে।
এরপর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামায়াতের শীর্ষনেতারা একের পর এক দণ্ডিত হলে দলটিতে এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায় বিএনপির মধ্যে; যদিও বিচ্ছেদের কথা বিএনপি কখনও বলেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি নতুন জোট করে, যদিও জামায়াত সঙ্গে ভোটের কৌশলী ঐক্য রেখে।
এর পরের বছরগুলোতে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনের কৌশল নিলে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দৃশ্যপট গেছে বদলে। তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক এখন রীতিমতো শত্রুতায় রূপ নিয়েছে।
একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকাকে সামনে এনে এখন আক্রমণ শানাচ্ছেন বিএনপি নেতারা, যে কথাগুলো আগে কখনও তাদের মুখ থেকে শোনা যায়নি। অন্যদিকে জামায়াত নেতারাও ছেড়ে কথা কইছেন না।
এরমধ্যে ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যেও সম্পর্ক বৈরী হয়ে উঠেছে। অভ্যুত্থানের পর ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগরসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রকাশ্যে আসা ভালো চোখে নেয়নি ছাত্রদল। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে প্রশাসন শিবিররকে সভায় ডাকায় তা নিয়ে আপত্তি আসে ছাত্রদলের কাছ থেকেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা বয়কট করে ছাত্রদলের নেতা রিফাত মাহমুদ বলেছিলেন, “আমরা বলেছিলাম যে শিবির এই ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত। ২২টা ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন তাদেরকে নিষিদ্ধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগও আছে। সেই প্রেক্ষাপটে আমরা বলেছি যে তাদের সঙ্গে থাকব না। তখন আমরা ওয়াকআউট করি।”
বিপরীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সেক্রেটারি মহিবুর রহমান বলেন, “এখানে কোনো একটা সংগঠন যদি আরেকটা সংগঠনের সঙ্গে বসতে না চায়, তাহলে তারা কি রাজনীতি করতে পারবে না? রাজনীতি করার অধিকার তো কোনো সংগঠন অন্য সংগঠনকে দিতে পারে না।”
এরপর কুয়েটে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর ছাত্রদল-শিবির দ্বৈরথ আরও বেড়ে যায়। জুরাই আন্দোলনের সময় শিবির নেতাদের ছদ্ম পরিচয়ে থাকার বিষয়টি তুলে তাদের ‘গুপ্ত’ সংগঠন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধের দাবি তোলে ছাত্রদল। শিবির নেতারা উল্টো ছাত্রদলকে দায়ী করে ছাত্রলীগের মতো আচরণের জন্য।

এই উত্তেজনা চলার মধ্যে ছাত্রশিবিরের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রদলকে নিয়ে বিষোদগার করেন।
তিনি বলেন, “নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বন্ধুপ্রতীম ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলকে তাদের পথ অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে।
“ক্যাম্পাসে সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসমূহের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও সহাবস্থান নিশ্চিত করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সকলের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনকে অন্যায়ভাবে দমনের চেষ্টা করছে।”
কুয়েটে সংঘর্ষের জন্য শিবিরকে দায়ী করে ছাতদলের নানা কর্মসূচির নিন্দাও জানান জাহিদুল। তিনি বলেন, “কুয়েটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততার মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে। খুলনার শিববাড়িতে তাদের মিছিল থেকে ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ এই স্লোগান দেওয়া হয়। এমন ভয়ংকর, হিংস্র স্লোগান আমরা ছাত্রলীগের মুখে শুনতাম।”
শিবিরের সংবাদ সম্মেলনের প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেন ছাত্রদল। এক বিবৃতিতে সংগঠনটির সভাপতি রাকিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন বলেছেন, মধুর ক্যান্টিনে শিবিরের উপস্থিতি ‘মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করে’।
তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসলামী ছাত্রশিবিরের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন শহীদ মধুদার প্রতি এবং তার পরিবারের প্রতি অসম্মানজনক। শহীদের নিজের আঙিনায় খুনির সহযোগীদের বিচরণ খুবই ন্যক্কারজনক ঘটনা। অনুতাপ এবং বিবেকবোধ থেকেই ছাত্রশিবির এর মধুর ক্যান্টিনে আসা উচিৎ নয়।”