মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এ টি এম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় যাকে আদালতের ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল, সেই মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এখন ভিন্ন ভূমিকায়; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর, অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রের প্রধান কৌঁসুলি।
প্রশ্ন ওঠেছে, এক সময়ে যে মক্কেলের পক্ষে লড়েছেন, এবার তার-ই বিপক্ষে দাঁড়ানো কতটুকু সম্ভব তাজুলের?
তাজুলের এই ‘স্বার্থের সংঘাত’ নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। মতামতটি লিখেছেন পত্রিকাটির একজন জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক।
তাজুল ইসলাম জামায়াতের আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। ট্রাইব্যুনালে যেসব জামায়াত নেতার বিচার হয়েছিল, তাদের প্রায় প্রত্যেকের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
এ ছাড়া বিগত সরকারের আমলে এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি নামে জামায়াত পন্থীদের নিয়ে যে দল দল গঠন করা হয়েছিল তাতেও তাজুল ইসলাম ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। অবশ্য ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি ওই দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
মূলত তাজুল ইসলামের এই ‘স্বার্থের সংঘাতের’ বিষয়টি সামনে আসে যখন তার এক সময়ের মক্কেলের রিভিউ আবেদনের শুনানির জন্য তাকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দাঁড়াতে দেখা যায়।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগে এ টি এম আজহারুলের করা রিভিউ আবেদন শুনানির বিষয়টিও উত্থাপন করেন তাজুল।
অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আজহারুলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা চলাকালে তার পক্ষের আইনজীবী ছিলেন তিনি।
এখন পরিবর্তিত ভূমিকার ফলে আজহারুলের বিরুদ্ধে মামলায় তাজুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা ‘স্বার্থের সংঘাত’ তৈরি করেছে কি না এবং তিনি পেশাগত আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না—এমন প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একটি মামলায় একজন আইনজীবী কখনো পক্ষ পরিবর্তন করতে পারেন না। অর্থাৎ কখনো বিবাদীর পক্ষে থাকলে আবার পরে বাদীর পক্ষে যেতে পারেন না। রাষ্ট্রপক্ষ বা কোনো ট্রাইব্যুনালের আইনজীবীর ক্ষেত্রেও এটা একইভাবে প্রযোজ্য।’
“আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো খুবই স্পর্শকাতর। তাই এ মামলায় আরও বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন ছিল। আজহারুলের মামলার ক্ষেত্রে কোনো আইনজীবী পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচারবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না, তা বার কাউন্সিলের যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত,” যোগ করেন শাহদীন মালিক।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচার বিধিমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ের (মক্কেলের প্রতি আচরণ) ২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান মক্কেল কিংবা পুরাতন মক্কেলের মামলা পরিচালনাকালে একজন আইনজীবী যদি মামলা-সংক্রান্ত কোনো গোপনীয় তথ্যাদি সম্বন্ধে অবগত হইয়া থাকেন, তবে উক্ত আইনজীবী উক্ত তথ্য নির্ভর কোনো মামলায় উক্ত মক্কেলের বিপক্ষে আইনজীবী হিসেবে নিয়োজিত হইতে পারিবেন না।
একই অধ্যায়ের ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একজন আইনজীবী পরস্পরবিরোধী কোনো ব্যাপারে কোনো মক্কেলের প্রতিনিধিত্ব করিতে পারিবেন না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর বাদী হিসেবে থাকেন চিফ প্রসিকিউটর। এ কারণে আজহারুলের রিভিউ শুনানিতে তাজুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি এখন এই মামলার বাদী।
অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে মামলাগুলোতে তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন, চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হয়ে গেছেন বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া এ বিষয়ে বলেন, “যে বা যারা আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন, তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় বিষয়টি নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। তাদের এই নিয়োগ নৈতিকভাবে সঠিক হবে কি না কিংবা ‘স্বার্থের সংঘাত’ তৈরি করবে কি না, অন্তর্বর্তী সরকারের আগেই তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল।”
আজহারুলের মামলায় তাজুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতা বার কাউন্সিলের পেশাগত আচরণ ও শিষ্টাচারবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মনে করেন তিনি।